সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ ও হতাশার ঢেউ বইছে, বিশেষ করে রাজনৈতিক রূপান্তরের পর স্থানীয়ভাবে কিছু বক্তব্য দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক দিক চিত্রকে বিকৃত করে তুলছে। অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে—এ দাবি বাস্তবতার তুলনায় অনেক বেশি অতিরঞ্জিত।
বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো অর্থনীতির পতনের নয়; বরং দীর্ঘদিনের চাপা সমস্যাগুলোর প্রয়োজনীয় উন্মোচন ও কাঠামোগত পুনর্গঠনের ফল। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, অকার্যকর ঋণ এবং ব্যাংক খাতের দুর্বলতা নিঃসন্দেহে গুরুতর, কিন্তু এগুলো নতুন সঙ্কট নয়—বরং বহু বছরের গোপন দুর্বলতা অবশেষে পরিস্কারভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। পূর্ববর্তী প্রশাসনের সময়ে তথ্য লুকানো, নিয়ম ঢিলেঢালা করা এবং অপরিকল্পিত ঋণ সম্প্রসারণের ফলে একটি “দৃষ্টিনন্দন কিন্তু দুর্বল” আর্থিক কাঠামো তৈরি হয়েছিল। আজকের সংশোধনমূলক পদক্ষেপগুলো সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার প্রক্রিয়া।
বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ ধাক্কা ও ইউক্রেন যুদ্ধের পরও বাংলাদেশ ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি ধরে রাখে—৩.৫%, ৬.৯% এবং ৭.১%। বর্তমান প্রবৃদ্ধির মন্থরতা পতনের ইঙ্গিত নয়; বরং দীর্ঘমেয়াদি সামষ্টিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে নেওয়া রাজস্ব ও আর্থিক কঠোরতার সরাসরি প্রভাব।
ADB তথ্য অনুযায়ী প্রকৃত অকার্যকর ঋণের পরিমাণ ২০%–৩৫% এর মধ্যে। এটি হঠাৎ সৃষ্ট সঙ্কট নয়—বরং বহু বছর ধরে ব্যাংক খাতে নিয়ম শিথিল ও রাজনৈতিকভাবে অনুমোদিত ঋণ পুনঃনির্ধারণের ফলে সৃষ্ট “মেকআপ দেওয়া ব্যালান্স শিট” এখন বাস্তব রূপে প্রকাশিত হচ্ছে। আজকের উচ্চ NPL তাই পতনের নয়—বরং সৎ হিসাবের প্রত্যাবর্তনের চিহ্ন। আজ ঋণের পরিমাণ কমলেও বরাদ্দ হচ্ছে তুলনামূলক নিরাপদ ও কার্যকর খাতে—যা একটি টেকসই অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য।
অর্থনীতিতে এক বড় পরিবর্তন হলো সরকারের ব্যাংক ঋণ নেওয়ার প্রবণতার হ্রাস। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই–অক্টোবর পর্যন্ত সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ না নিয়ে বরং ৫০০ কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করেছে—যা পূর্ববর্তী বছরের বিপরীত চিত্র। এটি সুদের হার স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করছে এবং বেসরকারি খাতে তারল্য বাড়াচ্ছে।
এরই মধ্যে FDI প্রায় ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে—যা রাজনৈতিক রূপান্তর-পরবর্তী অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত বিরল। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এই আস্থা বাংলাদেশের সম্ভাবনার দীর্ঘমেয়াদি শক্ত ভিত্তির প্রতিফলন। কয়েক মাসের ধসের পর রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে এক বছরের মধ্যেই ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি হয়েছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্স সর্বোচ্চ ৩০.৩৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে(২৬.৮% বৃদ্ধি)। হুন্ডির বিকল্প হিসেবে বৈধ চ্যানেলে ফেরত আসা, বাজারভিত্তিক ডলার রেট এবং মানি লন্ডারিং বিরোধী কঠোর ব্যবস্থা এই পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
৮%+ মুদ্রাস্ফীতি জনগণের ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করছে, তবে এটি শ্রীলঙ্কার মতো নৈতিক পতনের ফল নয়। এটি মূলত সরবরাহ সংকট, বাজার বিকৃতি এবং পূর্ববর্তী প্রশাসনের অতিরিক্ত অর্থ সরবরাহ নীতির ফল। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক মূল্যায়ন ইঙ্গিত দিয়েছে—মুদ্রাস্ফীতির মাঝেও দারিদ্র্যের সামান্য উন্নতি হতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে না। বরং বহুদিন ধরে গড়ে ওঠা দুর্বলতা ও বিকৃতি দূর করতে একটি কঠিন কিন্তু অত্যাবশ্যকীয় পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।উচ্চ NPL,ধীর ঋণ প্রবৃদ্ধি ,মুদ্রাস্ফীতি এসবই দীর্ঘমেয়াদি অবহেলার ফল, এবং এগুলো মোকাবিলা করাই বর্তমানে অগ্রাধিকারে রয়েছে। অন্যদিকে— রিজার্ভের শক্ত পুনরুদ্ধার ,রেমিট্যান্সে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি ,এফডিআই বৃদ্ধি ,আর্থিক শৃঙ্খলার নতুন দৃষ্টান্ত এসবই অর্থনীতির স্থায়িত্ব ও স্বচ্ছতার ভিত্তি জোরদার করছে।
Leave a comment