গাজীপুর মহানগরে সন্ধ্যা নামলেই নেমে আসে ভয়ের ছায়া। ব্যস্ত শিল্পনগরীর মানুষজন তখন ছুটতে থাকেন দ্রুত ঘরে ফেরার জন্য। নগরের রাস্তায় ঘোরাফেরা মানেই একধরনের আতঙ্ক, কারণ মুহূর্তেই ছিনতাই কিংবা চাঁদাবাজির কবলে পড়ার আশঙ্কা থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে পরপর কয়েকটি হত্যাকাণ্ড, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও ধর্ষণের ঘটনা গাজীপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
১৬ আগস্ট রাতে গাছা এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন এক ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি আশিক চৌধুরী। যাত্রীবেশে থাকা দুর্বৃত্তরা তাঁর কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা ও দুটি মুঠোফোন ছিনিয়ে নেয়। এর মাত্র কয়েক দিন আগে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে ছিনতাইকারীরা প্রকাশ্যে হত্যা করে। দুই ঘটনার ফারাক অল্প সময় হলেও বার্তাটি স্পষ্ট—নগরবাসীর নিরাপত্তা আজ গুরুতর সংকটে।
জিএমপির আটটি থানার আওতাধীন ৩৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বসবাস করেন প্রায় সাড়ে ৩৫ লাখ মানুষ। কিন্তু তাদের সুরক্ষায় নিয়োজিত ১ হাজার ৭৬৫ পুলিশ সদস্যের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সাধারণ মানুষ। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, পুলিশের টহল ও তল্লাশি কমে যাওয়ায় অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পুলিশের আগের মতো উপস্থিতি চোখে পড়ে না। অপরাধ ঘটলেও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি মাদক ব্যবসায়ী ও ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে মাসোহারা নেওয়ার কথাও এসেছে পুলিশের বিরুদ্ধে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সাম্প্রতিক এক তদন্ত প্রতিবেদনে গাজীপুরের আইনশৃঙ্খলাকে ‘খুবই খারাপ’ বলা হয়েছে। সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো অপরাধ দিন-দুপুরেও ঘটছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, গত ছয় মাসে দস্যুতা ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৩৪টি মামলা হয়েছে, যা আগের ছয় মাসের তুলনায় অনেক বেশি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা পুলিশের খাতায় ওঠে না, কারণ ভুক্তভোগীরা মামলা করতে দ্বিধায় ভোগেন।
সরেজমিনে নগরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে জানা যায়, অন্তত ১৯টি জায়গা ছিনতাইপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত। টঙ্গীর ব্রিজ ও বাজার, চান্দনা চৌরাস্তা, গাজীপুরা বাঁশপট্টি, ভোগড়া বাইপাস, তারগাছ, জয়দেবপুর বাজার—এসব এলাকায় সন্ধ্যা নামলেই ছিনতাই বেড়ে যায়। কিশোর ও যুবক বয়সের ছিনতাইকারীরা ধারালো অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের টার্গেট করছে। অনেক সময় চলন্ত বাসের জানালা দিয়েও মুঠোফোন ও গয়না ছিনিয়ে নেওয়া হয়। বাধা দিলে ঘটে প্রাণঘাতী হামলা।
শুধু ছিনতাই নয়, চাঁদাবাজির নেপথ্যে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের অভিযোগও উঠেছে। রিকশা, ফুটপাত কিংবা শিল্পকারখানা—সবখানেই চলছে চাঁদা আদায়। সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন চাঁদাবাজির খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হন। আবার নাসির পালোয়ান নামে ৯০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ স্থানীয় চাঁদাবাজ চক্রের হামলায় গুরুতর আহত হয়ে মারা যান। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি সাংবাদিকরাও নিরাপত্তাহীনতার শিকার।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার নাজমুল করিম খান দাবি করেছেন, রাতভর টহল ও ফাঁকা গুলি চালিয়ে ছিনতাই নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। তবে একই সঙ্গে তিনি স্বীকার করেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ৭২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে দুই লাখের বেশি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। তাঁদের একটি অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
ধর্ষণ ও নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনাও বাড়ছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত গাজীপুর মহানগরে ১৮৩টি মামলা হয়েছে, যেখানে আগের ছয় মাসে ছিল ১৩৮টি। অপহরণের ঘটনাও আগের তুলনায় তিনগুণ বেড়েছে।
এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরাও নিরাপত্তার দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে টঙ্গী কলেজ গেটে অবরোধ করে তারা বিক্ষোভ জানায়। নাগরিক সমাজের নেতারা বলছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই অপরাধীরা বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতা না থাকলে অপরাধ এতটা বিস্তৃত হতো না।
গাজীপুরের সাধারণ মানুষের দাবি একটাই—রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশি ব্যবস্থা ও কঠোর আইন প্রয়োগ। নাহলে শিল্পনগরী গাজীপুর রাত নামলেই যে আতঙ্কের শহরে পরিণত হচ্ছে, তা থামানো যাবে না।
Leave a comment