রাজধানীর চকবাজারের পলাশী মসজিদ এলাকায় ঘটে গেল এক মর্মান্তিক ঘটনা। মাত্র ১২ বছরের এক শিশু, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া মুক্তাদির, শুক্রবার রাত ১১টার দিকে নিজ বাসার বেলকনিতে গলায় গামছা পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ। এ ঘটনায় এলাকায় নেমে এসেছে শোক ও স্তব্ধতা।
চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ আশরাফুজ্জামান জানান, শিশুটির এমন মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং তা এক অপমৃত্যুর ঘটনা, যেখানে মা-বাবার সঙ্গে পারিবারিক টানাপোড়েন এবং পড়াশোনা নিয়ে চাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে তারা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছেন।
পুলিশ জানায়, পলাশী মসজিদ সংলগ্ন একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকতেন মুক্তাদির ও তার পরিবার। শুক্রবার রাত ১০টার দিকে একজন পথচারী পাশের ভবনের বারান্দা দিয়ে শিশুটিকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে বাড়ির লোকজনকে ডাক দেন। আতঙ্কগ্রস্ত পরিবার তাৎক্ষণিকভাবে শিশুটিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
চকবাজার থানার এক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই), যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, বলেন, “শিশুটিকে যখন উদ্ধার করা হয়, তখন তার গলায় গামছা শক্তভাবে প্যাঁচানো ছিল। আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছি। মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে।”
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মুক্তাদির স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিল। পড়াশোনায় তার আগ্রহ কম ছিল বলে জানান প্রতিবেশীরা। ঘটনার দিন রাতেও লেখাপড়ায় অমনোযোগী হওয়ায় তার মা কিছুটা বকাবকি করেন এবং সম্ভবত শারীরিকভাবে শাসনও করেন। এরপর মুক্তাদির অভিমানে নিজ ঘরের বারান্দায় গামছা দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পুলিশ জানিয়েছে, শিশুটির মা ঘটনার পর থেকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। তিনিও নিজেই জানিয়েছেন, “আমি তো একটু বকা দিয়েছিলাম, মারার জন্য নয়। কী করে এমন করল আমার ছেলে, আমি ভাবতেই পারছি না।”
এ নিয়ে প্রতিবেশীদের অনেকেই ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, শিশুদের মানসিক বিকাশে সহনশীলতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ জরুরি। মা-বাবার সঙ্গে কথাবার্তার অভাব, অহেতুক শাসন, আর সামাজিক চাপে বেড়ে ওঠা শিশুরা সহজেই ভেঙে পড়ছে।
স্থানীয় সমাজকর্মী ও শিশু মনোবিজ্ঞানী রুবিনা সুলতানা বলেন, “এই ঘটনা একটি ভয়াবহ বার্তা দেয়। শিশুরা তাদের মানসিক যন্ত্রণার কথা প্রকাশ করতে পারে না। শাসন যদি অপমানের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তবে তা শিশুর কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। বাবা-মায়ের উচিত সন্তানদের শোনার মনোভাব গড়ে তোলা এবং প্রতিদিন তাদের মানসিক অবস্থার খোঁজ নেওয়া।”
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, “শিশুর দেহে বাহ্যিক আঘাতের চিহ্ন না থাকলেও আত্মহত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হতে ময়নাতদন্ত করা হবে। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।”
চকবাজার থানার ওসি শেখ আশরাফুজ্জামান বলেন, “আমরা শিশুটির বাবা-মায়ের বক্তব্য নিয়েছি। কেউ দায়ী কিনা, সেটিও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে এটি আত্মহত্যার ঘটনা বলেই মনে হচ্ছে।”
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও নানান প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকেই লেখেন, শিশুদের প্রতি সহিংসতা বা অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ না করতে পরিবারের সদস্যদের মনোভাব বদলানো উচিত। অভিভাবকদের যত্ন ও সহানুভূতির অভাবেই এমন ঘটনা বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন অনেকে।
এদিকে, মুক্তাদিরের মৃত্যুর খবর জানাজানি হলে তার স্কুলের শিক্ষার্থীরাও শোকাহত হয়। স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, “ও খুব চুপচাপ ছিল। পড়াশোনায় দুর্বল হলেও ভদ্র ছিল। আমরা কখনও ভাবিনি এমন কিছু করবে।”
মুক্তাদিরের মরদেহ আজ শনিবার সকালে তার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে পাঠানো হয়েছে। সেখানে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে বলে জানা গেছে।
Leave a comment