রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে একটি চলন্ত ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছেন ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান বিভাগের পঞ্চম সেমিস্টারে পড়ুয়া শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান। শুক্রবার রাত ১০টার দিকে দনিয়া কলেজের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত ইসরাত ঢাকার রামপুরায় একটি হোস্টেলে থাকতেন এবং সেখান থেকেই প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করতেন। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার বাসিন্দা এই তরুণী পরিবারের আশার বাতিঘর ছিলেন।
দুর্ঘটনার পর পথচারীদের সহায়তায় ট্রাকচালক মাসুমকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। পরে সড়ক পরিবহন আইনে দায়েরকৃত মামলায় তাঁকে আদালতে উপস্থাপন করা হলে বিচারক কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শাহনেওয়াজ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘ইসরাত এক বন্ধুর সঙ্গে মোটরসাইকেলে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। ফেরার পথে দনিয়া কলেজ এলাকায় পিছন থেকে একটি দ্রুতগতির ট্রাক তাঁদের মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। এতে ইসরাত ছিটকে পড়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পান এবং ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।’
ইসরাতের সঙ্গে থাকা বন্ধু সামান্য আহত হলেও তিনি প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ আছেন বলে জানা গেছে। দুর্ঘটনার পর পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মিটফোর্ড) মর্গে পাঠায়। তবে নিহতের বাবা আবদুর রশিদ ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ গ্রহণের আবেদন জানান। আবেদনের প্রেক্ষিতে আজ শনিবার সন্ধ্যায় ইসরাতের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
আবদুর রশিদ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘মেয়েকে অনেক কষ্ট করে শহরে পাঠিয়েছিলাম পড়াশোনার জন্য। ওর স্বপ্ন ছিল প্রযুক্তিবিদ হওয়ার, নিজের পায়ে দাঁড়াবে—আমরাও অপেক্ষা করছিলাম মেয়ের চাকরির খবর শোনার। কিন্তু এখন ও শুধু কফিনে করে ফিরে আসছে। এই শোক ভাষায় প্রকাশ করার নয়।’
ইসরাতের সহপাঠী ও বন্ধুদের মধ্যেও শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক প্রকাশ করছেন এবং এই ঘটনার জন্য দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। তাদের অনেকে বলেন, রাজধানীতে দ্রুতগামী যানবাহনের নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং সড়ক নিরাপত্তার প্রতি প্রশাসনের অবহেলার কারণেই প্রতিনিয়ত এমন প্রাণহানি ঘটছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ইসরাত অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। সে নিয়মিত ক্লাস করত এবং সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। এমন আকস্মিক মৃত্যু আমরা কেউ মেনে নিতে পারছি না। সড়ক ব্যবস্থাপনায় আরও দায়িত্বশীলতা প্রয়োজন, না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বারবারই এইভাবে হারিয়ে যাবে।’
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ২০২৪ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ছয় হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এর একটি বড় অংশই তরুণ, কর্মক্ষম ও শিক্ষার্থী শ্রেণির মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপ্রশিক্ষিত চালক, বেপরোয়া গতি, যানবাহনের ফিটনেস ঘাটতি এবং সঠিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার অভাবই মূলত এসব মৃত্যুর প্রধান কারণ।
যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ জানিয়েছে, দুর্ঘটনার পর পরই ট্রাকটি জব্দ করা হয়েছে এবং চালকের লাইসেন্স, ট্রাকের ফিটনেস সনদ ও রুট পারমিট যাচাই করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে চালকের গাফিলতির প্রমাণ মিলেছে বলে পুলিশ জানায়।
এই ঘটনায় ঢাকাবাসীর মধ্যে আবারও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষার্থীরা ইসরাতের জন্য শোক জানিয়ে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, সড়কে বেরিয়ে পড়া যেন আর কারও শেষ যাত্রা না হয়—এই দায়িত্ব এখন রাষ্ট্রের।
ইসরাতের মৃত্যুর খবরে তাঁর গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার কলারোয়ায় শোকের মাতম চলছে। প্রতিবেশীরা জানান, ইসরাত গ্রামের গর্ব ছিল। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া ইসরাত নিজের চেষ্টা ও প্রতিভা দিয়ে শহরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাঁর এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
এই খবর লেখার সময় পর্যন্ত নিহত শিক্ষার্থীর জানাজার সময় ও স্থান নির্ধারণ হয়নি। তবে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, আজ রাতেই লাশ গ্রামে পৌঁছানোর কথা এবং কাল সকালে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।
দেশের তরুণদের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একটি নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার দাবি আবারও জোরালো হয়ে উঠেছে। সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্বহীনতার কারণে শিক্ষার্থী মৃত্যুর এ তালিকা যেন আর না বাড়ে—এই প্রত্যাশাই এখন সবার।
Leave a comment