পাকিস্তানের সঙ্গে সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘাতের উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হলেও ভারতের অভ্যন্তরে নতুন করে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে মোদি সরকারের নানা ধরপাকড় ও দমনমূলক পদক্ষেপ। সরকারের সমালোচনাকারী শিক্ষাবিদ ও সংস্কৃতিকর্মীদের বিরুদ্ধে যেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন দেশের বুদ্ধিজীবী ও মুক্তচিন্তার মানুষজন।
সম্প্রতি দিল্লি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আলি খান মাহমুদাবাদ নামে একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদকে। অভিযোগ, তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে কিছু প্রশ্ন তুলেছিলেন, যা ‘দেশবিরোধী’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। একই সঙ্গে ওভারসিজ সিটিজেনশিপ অব ইন্ডিয়া (ওসিআই) কার্ড বাতিল করা হয়েছে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত ভারতীয় বংশোদ্ভূত কাশ্মীরি পণ্ডিত অধ্যাপক নিতাশা কলের। এর ফলে তিনি এখন থেকে ভারত ভ্রমণে বিধিনিষেধের মুখে পড়লেন এবং দীর্ঘমেয়াদে ভারতে অবস্থান করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না।
ভারত সরকারের দাবি, অধ্যাপক নিতাশা ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ এবং ‘ঐতিহাসিক তথ্যকে বিকৃত করে’ আন্তর্জাতিক ফোরাম ও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে ভারতের সার্বভৌমত্বকে আঘাত করেছেন। তবে অধ্যাপক নিতাশা এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, এটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিশোধ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। এক বিবৃতিতে তিনি লিখেছেন, “এটি একটি খারাপ বিশ্বাসের সিদ্ধান্ত, আন্তর্জাতিক দমন-পীড়নের এক নিষ্ঠুর উদাহরণ। মোদি সরকারের সংখ্যালঘুবিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ে গবেষণার জন্য আমায় শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।”
২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর একই বছরের অক্টোবরে মার্কিন কংগ্রেসের হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটিতে কাশ্মীরের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। সেই সময় থেকেই বিজেপি নেতাদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমনকি ২০২৪ সালে বেঙ্গালুরু বিমানবন্দরে অবতরণের পর তাঁকে ভারতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি, যদিও কর্ণাটকের কংগ্রেস সরকার তাঁকে এক শিক্ষাবিষয়ক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। পরে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ভিএইচপির এক নেতা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ওসিআই কার্ড বাতিলের অনুরোধ করেন।
অন্যদিকে, মহারাষ্ট্রের নাগপুরে সম্প্রতি এক স্মরণসভায় উপমহাদেশের খ্যাতিমান কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের বিখ্যাত গান ‘হাম দেখেঙ্গে’ পরিবেশন করায় একদল তরুণ সাংস্কৃতিক কর্মীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। অভিযোগ, এই গান গাওয়ার মাধ্যমে তারা ‘গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি এবং প্রকাশ্য নৈরাজ্য’ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন।
আয়োজক সংগঠন বিদর্ভ সাহিত্য সংঘের এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন সমাজকর্মী উত্তম জায়গিরদার, যিনি সেখানে মহারাষ্ট্র সরকারের প্রস্তাবিত বিশেষ পাবলিক সিকিউরিটি বিল–২০২৪ সম্পর্কে সতর্কবার্তা দেন। বিশ্লেষকদের মতে, এই বিল আইনে পরিণত হলে ভিন্নমত দমন আরও সহজ হয়ে উঠবে এবং ‘আরবান নকশাল’ তকমা দিয়ে যেকোনো প্রগতিশীল চিন্তাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে।
এইসব ঘটনার প্রেক্ষিতে ভারতের স্বাধীন মত প্রকাশের পরিসর যে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে, তা নিয়ে দেশটির বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। সাংস্কৃতিক প্রতীক, মতপ্রকাশ ও মানবাধিকার সংক্রান্ত গবেষণাকে রাষ্ট্রদ্রোহের আওতায় এনে যেভাবে ব্যবস্থাগ্রহণ করা হচ্ছে, তাতে ভারতের গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
Leave a comment