তুরস্কের ইস্তাম্বুলে যখন আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা প্রশমনে শান্তি আলোচনা চলছে, ঠিক সেই সময়েই ফের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে কেঁপে উঠল আফগান-পাকিস্তান সীমান্ত। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, রবিবার (২৬ অক্টোবর) আফগান সীমান্তের কাছে সংঘর্ষে পাঁচ পাকিস্তানি সেনাসহ অন্তত ৩০ জন নিহত হয়েছেন।
নিহতদের মধ্যে ২৫ জনই তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) জঙ্গি বলে দাবি করেছে ইসলামাবাদ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণমাধ্যম শাখা ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে জানায়, কুররাম ও উত্তর ওয়াজিরিস্তান জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় আফগানিস্তান থেকে দুটি বড় জঙ্গি দল পাকিস্তানের ভেতরে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালালে এই সংঘর্ষ শুরু হয়।
আইএসপিআরের ভাষ্যমতে, “নিরাপত্তা বাহিনী দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানালে টিটিপি জঙ্গিরা ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালায়। পাল্টা অভিযানে ২৫ জন জঙ্গি নিহত হয়, যাদের মধ্যে চারজন আত্মঘাতী হামলাকারী ছিল।”
বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, অভিযানের সময় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে। তবে সংঘর্ষে পাকিস্তানের পাঁচ সেনা সদস্য প্রাণ হারান এবং আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন। নিহত সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আইএসপিআর তাদের ‘জাতির সাহসী সন্তান’ বলে উল্লেখ করেছে।
এই সংঘর্ষ এমন এক সময় ঘটল, যখন তুরস্কের ইস্তাম্বুলে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সহিংসতা প্রতিরোধে দ্বিতীয় দফা শান্তি আলোচনা চলছে। আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
আইএসপিআর বিবৃতিতে বলা হয়,“যখন দুই দেশের প্রতিনিধিরা আলোচনায় বসেছেন, ঠিক তখনই আফগান ভূখণ্ড থেকে টিটিপি জঙ্গিদের অনুপ্রবেশের এই চেষ্টা গভীর উদ্বেগের বিষয়। এটি আফগান অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।” পাকিস্তান সরকার দোহা চুক্তির উল্লেখ করে আফগান তালেবান প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন—তাদের ভূখণ্ড যেন পাকিস্তানবিরোধী সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার না হয়, সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
এ ঘটনার পর আফগান সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। কাবুল এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে সংঘর্ষের বিষয়ে মন্তব্য করেনি। তবে সীমান্তে বাড়তি উত্তেজনা এবং পারস্পরিক অভিযোগের কারণে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও জটিল হতে পারে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে যে আফগানিস্তান তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী বালুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)-এর মতো গোষ্ঠীগুলোর আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। এসব সংগঠন পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী, প্রশাসনিক স্থাপনা এবং সাধারণ নাগরিকদের ওপর ধারাবাহিকভাবে হামলা চালিয়ে আসছে।
রাষ্ট্র পরিচালিত পাকিস্তান টেলিভিশন (পিটিভি) জানায়, ইস্তাম্বুলে শনিবার অনুষ্ঠিত নয় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনায় গুরুত্ব পায়—আন্তঃসীমান্ত জঙ্গি কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে যৌথ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা গঠন,জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি পারস্পরিক সম্মান নিশ্চিত করা, সীমান্ত বাণিজ্য ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া উন্নত করা।
পিটিভির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পাকিস্তানের প্রস্তাবিত কাঠামো এখনো আলোচনাধীন রয়েছে এবং দ্বিতীয় দফা বৈঠকের ফলাফল ঘোষণা করা হয়নি।
ইসলামাবাদভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেহরান ইউসুফজাই বলেন,“পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে আস্থার সংকট এতটাই গভীর যে, সামান্য উসকানিতেও সীমান্তে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। উভয় পক্ষেরই এখন গঠনমূলক সংলাপ ও আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করা জরুরি।”
গত এক মাসে আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে সংঘর্ষের ঘটনায় উভয় পক্ষের অন্তত কয়েক ডজন মানুষ নিহত হয়েছেন। এই উত্তেজনার প্রেক্ষিতে তুরস্কের মধ্যস্থতায় শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু আলোচনার মাঝেই নতুন করে সহিংসতা শুরু হওয়ায়, আলোচনার ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
Leave a comment