বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে সালমান শাহ এক অমর নাম। মাত্র চার বছরের ক্যারিয়ারে ঢাকাই সিনেমার চিত্র পাল্টে দিয়েছিলেন তিনি। কোটি দর্শকের হৃদয়ে স্থান পাওয়া এই নায়ক ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মাত্র ২৫ বছর বয়সে মারা যান। আজ তাঁর মৃত্যুর ২৯ বছর পার হলেও প্রশ্ন থেকেই গেছে— তাঁর মৃত্যু আত্মহত্যা ছিল নাকি হত্যা?
ঘটনার দিন: ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬-
সেদিন সকালে রাজধানীর নিউ ইস্কাটন রোডের একটি ফ্ল্যাটে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় সালমান শাহকে। দ্রুত হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নেওয়া হলেও চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে ময়নাতদন্তে মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলা হয়। তবে পরিবার, বিশেষত তাঁর মা নীলা চৌধুরী শুরু থেকেই এই প্রতিবেদনে আপত্তি জানান।
নীলা চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী, সেদিন সকালেই সালমানের বাবা বাসায় যান কিন্তু তাঁকে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর ছেলের লাশ দেখে তিনি বুঝতে পারেন—ঘটনায় রহস্য আছে। পরিবারের দাবি, মৃত্যুর অবস্থান ও চিহ্নগুলো ‘অস্বাভাবিক’।
বিতর্কিত আগের দিন-
মৃত্যুর আগের সন্ধ্যায় এফডিসিতে ‘প্রেম পিয়াসী’ ছবির ডাবিং করতে যান সালমান শাহ। সেখানে সহ-অভিনেত্রী শাবনূরের সঙ্গে মজা করার সময় হঠাৎ স্ত্রী সামিরা এসে উপস্থিত হন। পরে উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়। অনেকেই মনে করেন, সেই ঘটনার রেশ পরদিন পর্যন্ত গড়ায়।
মামলা ও তদন্ত: ২৯ বছরের জট
ঘটনার পরপরই সালমানের বাবা অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেন। কিন্তু তদন্তে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবেদন সামনে আসে—
• ১৯৯৭ (সিআইডি): সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ।
• ২০১৪ (বিচার বিভাগীয় তদন্ত): মৃত্যুকে অপমৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
• ২০১৬ (পিবিআই তদন্ত শুরু): আদালতের নির্দেশে পুনঃতদন্ত।
• ২০২০ (পিবিআই প্রতিবেদন): আত্মহত্যার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে বলা হয়, মানসিক চাপ ও পারিবারিক সংকট এর কারণ।
• ২০২১: নীলা চৌধুরী প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে আদালতে নারাজি আবেদন করেন।
এখনও মামলাটি বিচারাধীন।
স্ত্রী সামিরার বক্তব্য-
বছর কয়েক আগে এক সাক্ষাৎকারে সামিরা দাবি করেন, “ইট ইজ সুইসাইড।” তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, সালমান এর আগে একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন এবং চিকিৎসা নথিতেও এর প্রমাণ রয়েছে। তবে এ বক্তব্য ভক্ত-পরিবারের সন্দেহ আরও গভীর করে।
চলচ্চিত্রে অবদান-
মাত্র চার বছরে প্রায় তিন ডজন ছবিতে অভিনয় করে নব্বই দশকের ঢাকাই চলচ্চিত্রকে নতুন জীবন দেন সালমান শাহ। তাঁর স্বাভাবিক অভিনয়, ফ্যাশন, সংলাপ বলার ভঙ্গি তরুণ প্রজন্মের জন্য ছিল এক অনুকরণীয় ধারা। মৌসুমীর সঙ্গে প্রথম জুটি বাঁধলেও শাবনূরের সঙ্গে তাঁর জুটি আজও রোমান্টিক চলচ্চিত্রের সোনালি অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয়।
ভক্তদের শোক ও স্মৃতি-
১৯৯৬ সালের সেই সকালে তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই দেশব্যাপী শোক নেমে আসে। ঢাকার রাস্তায় নেমে আসে হাজারো ভক্ত, শোকমিছিল হয়, সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যায়। সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়—“বাংলা চলচ্চিত্র শূন্য হলো।”
প্রায় তিন দশক পরও ভক্তরা তাঁকে ভুলে যাননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিদিনই আলোচনায় আসেন সালমান শাহ। নতুন প্রজন্মের কাছেও তিনি এখনও জনপ্রিয়, অমর এক নাম।
এখনো অমীমাংসিত রহস্য-
আজ ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫—সালমান শাহর মৃত্যুর ২৯ বছর। অসংখ্য তদন্ত, একের পর এক প্রতিবেদন, পারিবারিক আপত্তি ও ভক্তদের দাবির পরও উত্তর মেলেনি। তাঁর মৃত্যু আত্মহত্যা না হত্যা—এই প্রশ্নের সমাধান আজও অজানা।
তবে একটি সত্য অমোঘ—সালমান শাহ বেঁচে আছেন তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রে, ভক্তদের অন্তরে, আর ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় কিংবদন্তি হয়ে।
Leave a comment