সিলেটের ব্যস্ত জিন্দাবাজারের লতিফ সেন্টারের দ্বিতীয় তলার ২১৮ নম্বর দোকানে ঢুকলেই যেন ফিরে যাওয়া যায় এক ভিন্ন সময়ের পথে। দোকানটির নাম ‘ডিভিডি গ্যালারি’। প্রায় দুই যুগ ধরে এখানে সিডি-ডিভিডি আগলে রেখেছেন তারেক আহমদ। আজ যখন ইউটিউব, স্পটিফাই কিংবা মুঠোফোনে গান শোনা সবচেয়ে সহজ মাধ্যম, তখনও তাঁর দোকানে সযত্নে সাজানো আছে পুরোনো দিনের অডিও ক্যাসেট, ভিডিও সিডি আর ডিভিডি।
নব্বই দশক আর নতুন সহস্রাব্দের শুরুর দিকেই ক্যাসেট ও সিডি-ডিভিডির বাজার ছিল তুমুল জমজমাট। নতুন সিনেমা বা অ্যালবাম প্রকাশের দিন দোকানগুলোতে ভিড় হতো উপচে পড়া। সেই সময়ের রমরমা ব্যবসার সাক্ষী হয়ে আছে এই দোকানটিও। তবে সময়ের স্রোতে অনেক কিছুই বদলে গেছে। আশপাশের ক্যাসেট-সিডির দোকানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, ব্যবসায়ীরা পেশা বদল করেছেন, কিন্তু তারেক আহমদ রয়ে গেছেন তাঁর দোকানের সঙ্গেই।
২০০২ সালে মামাতো ভাই লিটন আহমেদের কাছ থেকে দোকানটির মালিকানা নেন তারেক। তখন দোকানের পরিধি ছিল বড়, ব্যবসাও জমজমাট। ২০০৫ সালের দিকে দিনে লাখ টাকার ক্যাসেট বিক্রির রেকর্ড রয়েছে তাঁর। ঈদের সময় দোকানে ভিড় থাকত সারারাত। ক্যাসেট পাওয়া মানেই ছিল এক ধরনের আনন্দ, কার আগে কোন গান বা সিনেমা পাওয়া গেল—এ নিয়েই হতো প্রতিযোগিতা। বিশেষ করে প্রবাসী ক্রেতাদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। লন্ডনপ্রবাসীরা ২০ পাউন্ডে ২০টি ক্যাসেট কিনতেন, যেখানে সেখানে একটি ক্যাসেটের দামই হতো ২০ পাউন্ড।
এখন সময় পাল্টেছে। গান বা সিনেমা দেখা যায় সহজেই অনলাইনে। কিন্তু তারেকের দোকানে এখনও লাখ টাকার বেশি মূল্যের ক্যাসেট ও সিডি-ডিভিডি মজুত আছে। নিয়মিতই ঢাকায় গিয়ে আনতে হয় নতুন স্টক। ক্রেতা কমলেও একেবারে হারিয়ে যায়নি। বিশেষ করে প্রবাসফেরত সিলেটিরা দেশে এলে এখনো খোঁজেন এই দোকান। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত তাঁদের আনাগোনা থাকে সবচেয়ে বেশি। ১৫ থেকে ২০টি ক্যাসেট একসঙ্গে কিনে নিয়ে যান অনেকে। তাঁদের তালিকায় থাকে প্রিয় শিল্পীর গান, কোরআন তিলাওয়াত কিংবা বাংলা গজলের ডিভিডি।
তারেক জানান, আগে যে ডিভিডি বিক্রি হতো ৬০ টাকায়, এখন তা ৯০ টাকা। ৫০ টাকার ভিডিও সিডি এখন ১৫০ টাকা। অনেকে পুরোনো গাড়ির অডিও সিস্টেমে বাজানোর জন্য ক্যাসেট খোঁজেন, কেউবা শখের বসে ঘরে থাকা সিডি-ডিভিডি প্লেয়ারে শুনতে আসেন। তরুণদের চেয়ে বয়স্ক ক্রেতারাই বেশি, তবে স্মৃতির টানে এখনো নতুন প্রজন্মের কিছু মানুষও ঢুঁ মেরে যান।
এই ডিজিটাল যুগে যেখানে সব কিছু হাতের মুঠোয় চলে এসেছে, সেখানে একটি ক্যাসেট বা সিডি হাতে পাওয়া যেন এক ভিন্ন রকম অনুভূতি। কারও জন্য এটি শৈশবে ফেরা, কারও জন্য হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া। তাই ‘ডিভিডি গ্যালারি’ শুধু একটি দোকান নয়, হয়ে উঠেছে সময়ের এক অনন্য স্মারক।
Leave a comment