গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্কে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আয়োজিত সমাবেশের পরপরই আওয়ামী লীগ এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা যে হামলা চালিয়েছেন, তা শুধু পাঁচটি প্রাণই কেড়ে নেয়নি—এটি নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দক্ষতা নিয়ে।
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো শেখ হাসিনার নিজের জন্মস্থান গোপালগঞ্জে এই হামলার ঘটনা ঘটেছে। এক বছর পেরোতে না পেরোতেই সেখানে আবারও রক্তপাত। এনসিপি তাদের ‘জুলাই পদযাত্রা’র অংশ হিসেবে এই সমাবেশের আয়োজন করেছিল। কিন্তু আগেই জানা থাকলেও প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেই কর্মসূচি ঘিরে যথাযথ প্রস্তুতি নেয়নি।
পুলিশ ও সেনা সদস্যদের উপস্থিতিতেই আওয়ামী লীগপন্থী হামলাকারীরা দেশীয় অস্ত্রসহ সংগঠিতভাবে শহরের অলিগলিতে তাণ্ডব চালায়। আগুন, ককটেল বিস্ফোরণ, সরকারি গাড়িতে হামলা, সবশেষে সরাসরি এনসিপির সমাবেশ ও গাড়িবহরে হামলা—এই পুরো ঘটনায় শেষ পর্যন্ত গুলি চালাতে বাধ্য হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এতে নিহত হন পাঁচজন, আহত হন অনেকেই।
এই সহিংসতা কেবল একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিকে আঘাত করেনি, বরং দীর্ঘমেয়াদে রাজনীতিতে যে অস্থিরতা তৈরি করতে যাচ্ছে, তাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এনসিপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই হামলা তাদের ওপর অবৈধ ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর পরিকল্পিত আক্রমণ। অন্যদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, এনসিপি গোপালগঞ্জে কর্মসূচির মাধ্যমে জনমত ও সহানুভূতি অর্জন করেছে ঠিকই, তবে ঘটনাটিকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত আগ্রাসী প্রচারণা কিছুটা উল্টো প্রতিক্রিয়াও তৈরি করেছে।
সরকারি দায়িত্বশীল মহলের ব্যর্থতাও এখন স্পষ্ট। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজেই স্বীকার করেছেন, গোয়েন্দা তথ্য থাকলেও সংঘর্ষের মাত্রা আঁচ করতে পারেননি তাঁরা। ফলে প্রশ্ন উঠছে, তাহলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে তো? নাকি উপদেষ্টা ও মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালনে গাফিলতি ছিল?
বিশ্লেষকদের মতে, গোপালগঞ্জে হামলাকারীদের সংগঠিত অবস্থান এবং সহিংসতাই প্রমাণ করে যে ওই অঞ্চলটি এখনো আওয়ামী লীগের ‘সুরক্ষিত ঘাঁটি’, যেখানে নিষিদ্ধ ঘোষিত দলগুলোর কর্মীরা অবস্থান করছে প্রশাসনের নীরবতার মধ্যেই। বিষয়টি সরকার অজানা, তা বিশ্বাস করা কঠিন।
এই ঘটনার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এনসিপির রাজনৈতিক অগ্রযাত্রা যেমন স্পষ্ট হচ্ছে, তেমনি নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে এমন সহিংসতা নির্বাচন-পূর্ব শান্তি ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলছে। নাগরিক সমাজের অনেকে আশঙ্কা করছেন, এটি নির্বাচন পেছানোর একটি অজুহাত হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে।
গোপালগঞ্জের রক্তাক্ত এই ঘটনা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে—বাংলাদেশের রাজনীতি এখনো প্রতিহিংসা, দখল ও হুমকির চক্রেই আবর্তিত হচ্ছে। এই চক্র থেকে মুক্তি পেতে রাজনৈতিক দলগুলোর পরিপক্বতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন, যা এখনো দৃশ্যমান নয়।
Leave a comment