বার্তা বিনিময়ের জনপ্রিয় অ্যাপ টেলিগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পাভেল দুরভ জানিয়েছেন, মৃত্যুর পর তিনি তাঁর সব সম্পত্তি শতাধিক সন্তানদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেবেন। তবে সন্তানদের এই সম্পদ পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে— অন্তত ৩০ বছর। সম্প্রতি ফ্রান্সের রাজনৈতিক সাময়িকী লে পোঁয়া-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান তিনি।
রুশ বংশোদ্ভূত ৪০ বছর বয়সী প্রযুক্তি উদ্যোক্তা দুরভ জানিয়েছেন, তাঁর নিজের ছয় সন্তান ছাড়াও, তিনি দীর্ঘ সময় ধরে শুক্রাণু দান করে আসছেন এবং সেই শুক্রাণু ব্যবহার করে জন্ম নেওয়া সন্তানদেরও তিনি নিজের বলে বিবেচনা করেন। তিনি স্পষ্ট বলেন, “তারা সবাই আমার সন্তান, তাদের অধিকারও সমান। আমি চাই না, আমার মৃত্যুর পর তারা একে অপরের বিরুদ্ধে সম্পত্তির জন্য লড়াই করুক।” সেই উদ্দেশ্যে তিনি ইতোমধ্যে একটি উইল প্রস্তুত করেছেন বলেও জানান।
দুরভ বলেন, তাঁর জীবনের কাজ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তিনি আগেভাগেই উত্তরাধিকারের বিষয়টি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনতে চেয়েছেন, যাতে তাঁর সন্তানরা ভবিষ্যতে নিরাপদ থাকেন এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান টেলিগ্রামও যেন একই নীতিতে পরিচালিত হতে পারে। উইলে তিনি নির্ধারণ করেছেন, কোনো সন্তানই আগামী ৩০ বছরের মধ্যে তাঁর সম্পদ পাবে না। দুরভ চান, তাঁর সন্তানরা যেন নিজের জীবন নিজের মতো গড়তে শিখে— অর্থনির্ভরতা নয়, বরং আত্মনির্ভরতা ও সৃজনশীলতা দিয়ে।
দুরভের মতে, “আমি চাই, তারা সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করুক। নিজের যোগ্যতায় বড় হোক, আত্মবিশ্বাসী হোক, আর সৃজনশীল হোক। শুধু ব্যাংক হিসাব নয়, মানুষের মূল্যবোধই গুরুত্বপূর্ণ।”
২০২৩ সালে দুরভ প্রথমবারের মতো জানান যে, তিনি ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে শুক্রাণু দান করে আসছেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, একজন চিকিৎসক একবার তাঁকে বলেন, এই কাজটি একটি ‘নাগরিক দায়িত্ব’, কারণ তাঁর শুক্রাণুর গুণগত মান ‘উন্নত’। এই বিবেচনায় বহু দম্পতির সন্তান লাভে ভূমিকা রেখেছেন দুরভ।
ব্লুমবার্গের তথ্যমতে, পাভেল দুরভের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদিও দুরভ এই হিসাবকে বাস্তবভিত্তিক নয় বরং ‘তাত্ত্বিক’ হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “যেহেতু আমি টেলিগ্রাম বিক্রি করছি না, তাই এই সম্পদের পরিমাণ এক প্রকার কাগুজে। আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এত অর্থ নেই। যেটুকু নগদ বা স্থাবর সম্পদ আছে, তা মূলত এসেছে ২০১৩ সালে বিটকয়েনে বিনিয়োগ থেকে, টেলিগ্রাম থেকে নয়।”
পাভেল দুরভ বর্তমানে দুবাইয়ে বসবাস করছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ টেলিগ্রাম বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় যোগাযোগমাধ্যম, যার মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ কোটির বেশি। যদিও সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরে এসেছে অ্যাপটি। অভিযোগ উঠেছে, টেলিগ্রামকে ব্যবহার করে অর্থ পাচার, মাদক ব্যবসা ও শিশু পর্নোগ্রাফির মতো অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে।
২০২৪ সালে প্যারিসে দুরভকে কিছু সময়ের জন্য গ্রেপ্তারও করা হয়। যদিও তিনি এসব অভিযোগ জোরালোভাবে অস্বীকার করেছেন। তাঁর বক্তব্য, “অপরাধীরা আমাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বলে আমাদের দায়ী করা যায় না। এটা যেমন অযৌক্তিক, তেমনি হাস্যকরও।”
সাক্ষাৎকারে দুরভ বারবারই তাঁর প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও নীতিগত অবস্থানের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “টেলিগ্রাম একটি মূল্যবোধের প্রতীক, যেখানে গোপনীয়তা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।” তিনি চান, ভবিষ্যতেও টেলিগ্রাম যেন সেই আদর্শ বজায় রেখে চলতে পারে, এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরেও।
বিশ্ব প্রযুক্তি জগতে দুরভের এই সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন নতুন দৃষ্টান্ত, অন্যদিকে বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এই ‘উদার’ সিদ্ধান্ত সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল উদ্যোগের প্রতিচ্ছবি, আবার অনেকে মনে করছেন, বিষয়টি প্রযুক্তি উদ্যোক্তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হলেও তা সমাজ ও পরিবার কাঠামোয় একটি নতুন বাস্তবতা তুলে ধরছে।
সূত্র: সিএনএন
Leave a comment