Home শিক্ষা অন্যান্য আপনি কি জানেন ‘প্রোপাগান্ডা’ কী? – মনের খেলা, চোখের ধোঁকা!
অন্যান্যশিক্ষা

আপনি কি জানেন ‘প্রোপাগান্ডা’ কী? – মনের খেলা, চোখের ধোঁকা!

Share
Share

একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। কয়েক সেকেন্ডের ক্লিপে দেখানো হচ্ছে বিশৃঙ্খলা, শিরোনামে বড় বড় শব্দ—দেশের বিপদ আসন্ন! আপনার নিউজফিড ভেসে যাচ্ছে নানা মন্তব্যে। কিন্তু আসলেই কি সব সত্য! নাকি এটি একটি প্রোপাগান্ডার অংশ?
প্রোপাগান্ডা এমন এক শক্তিশালী অস্ত্র, যা সত্যের চেহারা বদলে দিতে পারে। যুগে যুগে এটি ব্যবহার হয়েছে যুদ্ধ থেকে রাজনীতি, বিজ্ঞাপন থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আসুন, এই রহস্যময় শব্দটির ইতিহাস, ধরন, প্রভাব এবং বর্তমান উদাহরণ নিয়ে একবার ডুব দিই!
‘Propaganda’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘Propagare’, যার অর্থ হলো প্রচার বা ছড়িয়ে দেওয়া। ১৬২২ সালে ক্যাথলিক চার্চ প্রথম প্রোপাগান্ডা ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের ধর্মীয় মতবাদ প্রচার করে। বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশপ্রেম জাগাতে ও শত্রুকে দুর্বল দেখাতে প্রোপাগান্ডার পোস্টার এবং প্রচারচলছিল জোরেশোরে। একটা জনপ্রিয় পোস্টারের কথা বলি – Uncle Sam Wants You। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি এমন প্রভাব ফেলেছিল যে লাখো তরুণ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। প্রোপাগান্ডা বিভিন্ন রূপে আসে। কখনও সরাসরি, কখনও আড়ালে।
ব্ল্যাক প্রোপাগান্ডা (Black Propaganda) হলো মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে এক বিখ্যাত ব্ল্যাক প্রোপাগান্ডার ঘটনা ঘটেছিল, যা ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে। এটি ছিল গ্লাইভিৎস ইনসিডেন্ট (Gleiwitz Incident, 1939)
১৯৩৯ সালের ৩১ আগস্ট, জার্মানির গ্লাইভিৎস নামক শহরের একটি রেডিও স্টেশনে হঠাৎ আক্রমণ হয়। রেডিওতে পোলিশ ভাষায় বার্তা প্রচার করে বলা হয় যে, পোল্যান্ড জার্মানির ওপর আক্রমণ করেছে। এই আক্রমণটি আসলে পুরোপুরি সাজানো ছিল। জার্মানির গোপন পুলিশ (SS) সদস্যরা পোল্যান্ডের সেনাদের পোশাক পরে নিজের দেশের রেডিও স্টেশনে হামলা চালায় এবং ইচ্ছাকৃতভাবে প্রোপাগান্ডা বার্তা ছড়ায়। কিছু নিরীহ লোককে হত্যা করে ঘটনাস্থলে রেখে দেওয়া হয়, যাতে পোল্যান্ডকে দোষী প্রমাণ করা যায়। এই সাজানো হামলার মাধ্যমে জার্মানি বিশ্বের সামনে পোল্যান্ডকে আক্রমণকারী হিসেবে তুলে ধরে এবং এই মিথ্যা অজুহাতে পরদিন, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে, পোল্যান্ডে আক্রমণ চালিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে। এই ব্ল্যাক প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে হিটলার বিশ্ববাসীর কাছে যুদ্ধের ন্যায্যতা দেখাতে চেয়েছিল। এটি ইতিহাসে প্রমাণিত একটি ভয়ংকর কৌশল হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, প্রোপাগান্ডা শুধু মিথ্যা প্রচারণা নয়, এটি কখনও কখনও বিশ্বযুদ্ধের মতো ভয়াবহ ঘটনার জন্ম দিতে পারে।
হোয়াইট প্রোপাগান্ডা (White Propaganda) হলো পরিষ্কারভাবে কার উদ্দেশ্যে এবং কোথা থেকে প্রচার হচ্ছে জানিয়ে তথ্য প্রচার করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি আইকনিক প্রচারণা চালানো হয়েছিল, যা ইতিহাসে অন্যতম সফল হোয়াইট প্রোপাগান্ডা হিসেবে পরিচিত। এই প্রচারণার মুখ ছিলেন—রোজি দ্য রিভেটার (Rosie the Riveter, 1940s)
১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যোগ দেওয়ার পর দেশের অধিকাংশ পুরুষ সৈন্য হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে যায়। ফলে ফ্যাক্টরি ও শিল্পক্ষেত্রে বিশাল শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। এই সময় সরকার ও গণমাধ্যম প্রচারণা চালাতে শুরু করে নারীদের কর্মক্ষেত্রে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে। ১৯৪৩ সালে জে. হাওয়ার্ড মিলার (J. Howard Miller) তৈরি করেন বিখ্যাত পোস্টার—We Can Do It! যেখানে লাল স্কার্ফ পরা এক শক্তিশালী নারীকে কাজের পোশাকে বুড়ো আঙুল গুটিয়ে সাহসী ভঙ্গিতে দেখা যায়। এই নারীই ছিলেন রোজি দ্য রিভেটার, যা নারীদের শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হয়ে ওঠে। এটি সরাসরি মার্কিন সরকার ও ওয়ার প্রোডাকশন বোর্ড (War Production Board) এর উদ্যোগে ছড়ানো হয়েছিল। একইসাথে নারীদের উৎসাহিত করা যাতে তারা যুদ্ধকালীন শিল্প, কারখানা, এবং অস্ত্র উৎপাদনের কাজে যোগ দেন। পাশাপাশি প্রচারণার মূল বার্তা ছিল জাতীয় স্বার্থে কাজ করার আহ্বান, যা সত্য ও বাস্তবধর্মী ছিল। যার ফলে লক্ষাধিক নারী প্রথমবারের মতো ফ্যাক্টরি, অস্ত্র কারখানা এবং শিল্পখাতে কাজ শুরু করে। নারীদের শ্রমশক্তির গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি নারীবাদের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হয়ে ওঠে। যুদ্ধকালীন অর্থনীতিতে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং এটি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তিকে শক্তিশালী করে তোলে।
রোজি দ্য রিভেটার একটি আদর্শ হোয়াইট প্রোপাগান্ডার উদাহরণ, যেখানে খোলামেলা ও ইতিবাচক বার্তার মাধ্যমে সমাজের বড় পরিবর্তন আনা হয়েছিল। এটি শুধু যুদ্ধকালীন প্রচারণা ছিল না, বরং একটি সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করেছিল।

গ্রে প্রোপাগান্ডা (Grey Propaganda) কখনও সত্য, কখনও মিথ্যার মিশ্রণ। ইতিহাস থেকে একটি গ্রে প্রোপাগান্ডার উদাহরণ গালফ অব টঙ্কিন ঘটনা (Gulf of Tonkin Incident, 1964)
১৯৬৪ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে যে, উত্তর ভিয়েতনামের নৌবাহিনী তাদের একটি যুদ্ধজাহাজ USS Maddox-এর উপর গালফ অব টঙ্কিনে আক্রমণ চালিয়েছে। এই ঘটনার ভিত্তিতে মার্কিন কংগ্রেস Gulf of Tonkin Resolution পাশ করে, যা প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসনকে ভিয়েতনামে সরাসরি সামরিক অভিযান পরিচালনার পূর্ণ অধিকার দেয়। যুক্তরাষ্ট্র এমনভাবে প্রচার করেছিল যেন তাদের উপর বিনা উসকানিতে হামলা হয়েছে, কিন্তু পুরো সত্য গোপন করা হয়েছিল। পরবর্তী তদন্তে দেখা যায়, প্রথম হামলার ঘটনা আংশিক সত্য হলেও দ্বিতীয় হামলার দাবি ছিল সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এর উদ্দেশ্য ছিল জনমত গঠন ও কংগ্রেসকে যুদ্ধে নামার অনুমতি পেতে প্রভাবিত করা। মার্কিন মিডিয়া এবং সরকারের প্রচারণায় এই ঘটনাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যে, জনগণ মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও মুক্তির জন্য ভিয়েতনাম যুদ্ধ অপরিহার্য। এর ফলে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়িয়ে পড়ে, যা কয়েক বছর ধরে চলে এবং ৩০ লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। পরে জনসাধারণ পরে বুঝতে পারে যে, এই যুদ্ধে জড়ানোর পিছনে মূল কারণ প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে তৈরি করা একটি অর্ধসত্য পরিস্থিতি। অর্ধসত্য এবং অসম্পূর্ণ তথ্য কতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারে, গালফ অব টঙ্কিন তার একটি বড় উদাহরণ। এটি প্রমাণ করে যে, প্রোপাগান্ডা শুধু গণমত নয়, বিশ্ব রাজনীতিকেও বদলে দিতে পারে।
বর্তমান বিশ্বে রাশিয়া-ইউক্রেন সোশ্যাল মিডিয়ায় দুই পক্ষই নিজেদের বিজয় দেখিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে। বড় বড় কোম্পানি পণ্য বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপনে মানুষের ইমোশন ব্যবহার করে। যেমন, এই সাবান না ব্যবহার করলে আপনি সুন্দর নন টাইপের প্রচারণা। বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন গুজব ছড়ানো হয়। যেমন, একটি দল ইভিএম হ্যাক করছে বা অন্য দল জনসমর্থন হারিয়েছে ইত্যাদি। আবার একটি সময় পদ্মা সেতু নিয়ে গুজব ছড়ানো হয়েছিল—সেতুর জন্য মানুষের মাথা লাগবে! এই গুজব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল।

কিভাবে প্রোপাগান্ডা চিনবেন? প্রোপাগান্ডা চেনার উপায়:
১. তথ্যের উৎস যাচাই করুন: কে বলছে, কোন মাধ্যমে বলছে, এবং সেই মাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা কেমন?
২. আবেগের খেলায় পা দেবেন না: প্রোপাগান্ডা প্রায়ই ভয়, ঘৃণা বা উচ্ছ্বাসের মাধ্যমে মানুষকে প্রভাবিত করে।
৩. একাধিক উৎস থেকে তথ্য নিন: একটি বিষয় সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন সংবাদ মাধ্যম কী বলছে, তা যাচাই করুন।
৪. ফ্যাক্ট চেকিং টুল ব্যবহার করুন: বিভিন্ন ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট ব্যবহার করে সত্য-মিথ্যা যাচাই করুন।

প্রোপাগান্ডা থেকে বাঁচতে আমাদের করণীয়:
🔒 ডিজিটাল লিটারেসি বাড়ান: সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট শেয়ার করার আগে যাচাই করুন।
🧠 সমালোচনামূলক চিন্তা করুন: কোনো বিষয় পড়ে বা শুনে আগে ভাবুন, এটি বিশ্বাসযোগ্য কি না।
🌐 সচেতনতা তৈরি করুন: পরিবার ও বন্ধুদের প্রোপাগান্ডার ফাঁদ থেকে সতর্ক করুন।

প্রোপাগান্ডা ভালো বা খারাপ নয়, এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি ব্যবহার করা হয় মানুষের মন নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু আপনার হাতে একটি শক্তি আছে—সচেতনতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তা। তাহলে বলুন, আপনি কি আজ থেকে প্রোপাগান্ডার ফাঁদে পা দেবেন, নাকি বুদ্ধিমত্তার সাথে সত্যের পথে চলবেন?
আপনার মতামত জানাতে কমেন্টে লিখুন! এই লেখাটি শেয়ার করে অন্যদের সচেতন করুন!

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don't Miss

ট্রাম্পকে হত্যার টাকা জোগাড় করতে বাবা-মাকে খুন

এক কিশোর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যার জন্য টাকা জোগাড় করতে বাবা-মাকে খুন করেছে । ফেডারেল কর্তৃপক্ষ নতুনভাবে প্রকাশিত আদালতের নথির ভিত্তিতে এ তথ্য...

যারা আমাকে চেনে না তারা যান, গুগল করে তারপর ফিরে আসুন – শাহরুখ খান

“বলিউডের বাদশাহ” হিসেবে পরিচিত শাহরুখ খান অসংখ্য ব্লকবাস্টার ছবিতে অভিনয় করেছেন, সমালোচকদের প্রশংসা এবং তাঁর দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বিশাল ভক্ত অনুসারী অর্জন করেছেন। চলচ্চিত্র...

Related Articles

আজ থেকে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু

আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হয়েছে। প্রথম...

কুয়েটে সহিংসতায় ছাত্রদলের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ হামলার অভিযোগ

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে...

অস্থিরতার জেরে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ কুয়েট

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) কর্তৃপক্ষ জরুরি সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয়টি ২৮...

ঢাকায় প্রথম বইমেলা: ১৯৫৪ সালের এক ঐতিহাসিক আয়োজন

আজকের অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় উৎসব। কিন্তু এর শেকড়...