জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সরকারের সর্বোচ্চ পদে থাকা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের নিষ্পত্তি হওয়ায় এই রায়কে একটি ‘ঐতিহাসিক মোড়ঘোরানো মুহূর্ত’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সোমবার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১–এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ দীর্ঘ ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ পাঠ করেন এবং পরে রায় ঘোষণা করেন। দুপুর ১২টা ৩৪ মিনিটে রায় পাঠ শুরু হয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে চলার পর এ রায় দেওয়া হয়। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
ট্রাইব্যুনাল জানায়, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা তিনটি অভিযোগের সবগুলোই প্রমাণিত হয়েছে। প্রথম অভিযোগে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং দ্বিতীয় অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন রাজসাক্ষী হয়ে তদন্তে সহযোগিতা করায় তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
রায় ঘোষণার পর স্বাভাবিকভাবেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার। দীর্ঘ বিচারিক অভিজ্ঞতা ও কঠোর পেশাদারিত্বের জন্য তিনি বিচার অঙ্গনে সুপরিচিত।
ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়নের হাসানপুর গ্রামের এই বিচারকের জন্ম ১৯৬০ সালের ১৫ জানুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও এলএলএম সম্পন্ন করার পর ১৯৮২ সালে তিনি বিসিএস (বিচার) উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৯৩ সালের ২০ এপ্রিল বিচার বিভাগে যোগদান করেন। প্রায় ১৯ বছর জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ২০১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি অবসর গ্রহণ করেন তিনি।
দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তিতে ২০২৪ সালের ৮ অক্টোবর তাকে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত হলে তাকে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আইন সচিবের স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ধারা ৬ অনুযায়ী এ নিয়োগ কার্যকর হয়।
বোঝা যায়, রায়টি দেশের জনজীবনে কতটা গুরুত্ব বহন করছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ প্রায় সব বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে রায়টি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে বড় পর্দায়ও রায় দেখানো হয়, যেখানে হাজারো মানুষ জড়ো হয়ে বিচার কার্যক্রম অনুসরণ করে।
এদিকে মামলার প্রধান দুই আসামি—শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খান কামাল—রায় ঘোষণার আগেই ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার কার্যক্রম এগিয়ে চলে। অন্যদিকে গ্রেপ্তার থাকা একমাত্র আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন আদালতে জবানবন্দি দিয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করেন এবং রাজসাক্ষী হন।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাইব্যুনালের এই রায় ভবিষ্যতে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করবে।
রায় ঘোষণার পর বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার হাসানপুর গ্রামে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কড়া করে দেওয়া হয়েছে। সকালে স্থানীয় পুলিশ তার বাড়িতে বিশেষ পাহারা বসায়। ফুলগাজী থানার ওসি মুহাম্মদ লুৎফর রহমান বলেন, “বিচারপতি সাহেবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে এবং পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।”
এই রায়কে অনেকে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার নতুন অধ্যায় হিসেবে দেখছেন। একই সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গনেও এর প্রভাব বিস্তার করবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
Leave a comment