ভারত বাংলাদেশকে দেওয়া দুটি স্থলবন্দর — পেট্রাপোল ও গেদে — ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে রপ্তানি পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে। গত মঙ্গলবার ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি) ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। পরে এক বিজ্ঞপ্তিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশের জন্য যে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, তাতে ভারতের বিমান ও সমুদ্রবন্দরে উল্লেখযোগ্য জট হতো। ফলে পণ্য নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি ও রপ্তানিকারকদের খরচ বেড়ে যেত। এর ফলে গতকাল বেনাপোল বন্দর থেকে রপ্তানিমুখী চারটি ট্রাক ভারতে প্রবেশের আগেই ফেরত পাঠানো হয়।
সিবিআইসির প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০২০ সালের ২৯ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে পেট্রাপোল স্থলবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশি পণ্যকে কলকাতা স্থল ও বিমানবন্দর এবং মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ে নাভা শিভাবন্দরে পরিবহনের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া একই সময় রেল সুবিধা ব্যবহার করে পেট্রাপোল ও গেদে বা রানাঘাট স্থলবন্দর ব্যবহার করে নাভা শিভাবন্দরে পণ্য পরিবহনের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, যা বাতিল করা হলো। তবে ২০২৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আগের বিজ্ঞপ্তিটি সংশোধন করে শুধু কলকাতা বিমানবন্দরের সঙ্গে দিল্লি বিমানবন্দরের এয়ার কার্গোকেও সংযুক্ত করে।
ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল হলেও ভারতের দাবি, নেপাল ও ভুটানে রপ্তানির ক্ষেত্রে এ সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়বে না। তবে বাংলাদেশের জন্য এ সিদ্ধান্ত একটি তাৎপর্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বার্তা বহন করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ পরিস্থিতিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গতকাল রাতে জরুরি বৈঠক করে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাও অনলাইনে যুক্ত ছিলেন। উপদেষ্টা জানান, ঢাকা ও সিলেট বিমানবন্দরের সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা চলছে।
অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বাণিজ্যিক অবস্থানের সঙ্গে মিল রেখে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তিনি বলেন, “এটি লজিস্টিক্যাল ব্যয় বাড়াবে এবং বাংলাদেশের রপ্তানি কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটতে পারে।”
একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, “গত পাঁচ বছরে এই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা ব্যবহার করে সামান্য পরিমাণ পণ্য চলাচল করেছে। তাই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতি সীমিত হলেও কূটনৈতিক দিক থেকে এটি গুরুত্ব বহন করে। তবে তাৎক্ষণিক এ বিষয়ে বাংলাদেশের পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখানো ঠিক হবে না”।
ভারত হয়ে নেপাল ও ভুটানে কিছু গার্মেন্ট পণ্য যায়। এটিও রপ্তানি হারের তুলনায় অনেক কম বলে মন্তব্য করেন বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, আমার ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত শুল্কনীতি ভারতকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করেছে। তারা হয়তো ভেবেছে, এই সুযোগ অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের পণ্য সেখানে নিয়ে ‘মেড ইন ভারত’ লিখে রপ্তানি করার সুযোগ নিতে পারে অসাধু ব্যবসায়ীরা। হয়তো এ কারণে সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। এটিকে কূটনৈতিক চ্যানেলে মোকাবিলা করতে হবে।
এ বিষয়ে ভারতের পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী সমকালকে বলেন, স্থলবন্দর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা বন্ধের জন্য ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় একটি চিঠি ইস্যু করেছে কাস্টমসে। এ চিঠির আলোকে ট্রানজিট সুবিধার পণ্য বেনাপোল থেকে পেট্রাপোল বন্দরে প্রবেশ বন্ধ রয়েছে। বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুজিবর রহমান বলেন, ভারত সরকার ট্রানজিট সুবিধা বাতিল করায় আজ (বুধবার) বেনাপোল থেকে চারটি রপ্তানি পণ্যবোঝাই ট্রাক ফেরত গেছে। ঢাকার রপ্তানিকারক ডিএসভি এয়ার অ্যান্ড সি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠানের ছিল ট্রাকগুলো।
বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা বিষয়টিকে কূটনৈতিক পর্যায়ে সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন। ভারতের বেসরকারি সমুদ্রবন্দর ব্যবহারে অনীহা এবং দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের শীতলতা—এই সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্ব দিতে বলছেন তারা।
চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আগামী বৃহস্পতিবার একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
Leave a comment