ইতিহাস-
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ফরবিডেন সিটি (Forbidden City, 紫禁城, Zǐjìnchéng) দীর্ঘদিন ধরে চীনা সম্রাটদের
রাজপ্রাসাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। মিং রাজবংশের ইয়ংলে সম্রাটের নির্দেশে ১৪০৬ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় । প্রায় ১৪ বছরের কাজ শেষে ১৪২০ সালে প্রাসাদটি সম্পূর্ণ হয়।
এরপর প্রায় পাঁচ শতাব্দী ধরে মিং (১৩৬৮–১৬৪৪) এবং চিং (১৬৪৪–১৯১১) রাজবংশের সম্রাটরা এখান থেকেই শাসন পরিচালনা করেন। শেষ সম্রাট পু ই ১৯১২ সালে সিংহাসন ত্যাগের পরও কিছুদিন প্রাসাদের একাংশে বসবাস করেন। অবশেষে ১৯২৫ সালে এটিকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে প্যালেস মিউজিয়াম (故宫博物院, Gùgōng Bówùyuàn) হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
নামকরণের কারণ-
‘ফরবিডেন সিটি’ নামটির পেছনে রয়েছে কড়া নিরাপত্তার ইতিহাস। প্রাচীনকালে সাধারণ মানুষের প্রবেশ এখানে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। কেবল সম্রাট, তার পরিবার, কর্মচারী ও প্রহরীরাই প্রাসাদে প্রবেশাধিকার পেতেন।
চীনা নাম Zǐjìnchéng (紫禁城)-এর আক্ষরিক অর্থ ‘বেগুনি নিষিদ্ধ নগরী’। এখানে ‘বেগুনি’ শব্দটি উত্তর নক্ষত্রকে নির্দেশ করে, যা প্রাচীন চীনা বিশ্বাস অনুযায়ী সম্রাটকে আকাশের কেন্দ্রীয় নক্ষত্রের প্রতীক হিসেবে প্রকাশ করত।
আয়তন ও স্থাপত্য-
ফরবিডেন সিটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাচীন প্রাসাদ ।
• আয়তন: প্রায় ৭,২০,০০০ বর্গমিটার (৭২ হেক্টর)
• ভবন: ৯৮০টিরও বেশি
• কক্ষ: প্রায় ৮,৭০০
• প্রাচীর: উচ্চতা প্রায় ১০ মিটার
• খাল: দৈর্ঘ্য ৩.৫ কিমি, প্রস্থ প্রায় ৫২ মিটার
পুরো কমপ্লেক্সটি উত্তর-দক্ষিণ অক্ষ বরাবর সাজানো, যা চীনা স্থাপত্যে ভারসাম্য ও ফেং শুই নীতির প্রতিফলন ঘটায়।
স্থাপত্য বিন্যাস-
ফরবিডেন সিটির কাঠামো মূলত তিন ভাগে বিভক্ত—
(.) সামনের আঙিনা (Outer Court): রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান, সভা ও আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমের স্থান। এখানে অবস্থিত বিখ্যাত হল অব সুপ্রিম হারমনি (太和殿, Tài Hé Diàn), যেখানে সম্রাটের সিংহাসন ছিল।
(.) ভেতরের আঙিনা (Inner Court): সম্রাট ও পরিবারের আবাসস্থল। প্যালেস অব হেভেনলি পিউরিটি (乾清宫, Qián Qīng Gōng) ছিল সম্রাটের প্রধান বসবাসের স্থান।
(.) উদ্যান (Imperial Garden): উত্তরে অবস্থিত এই উদ্যান ছিল সম্রাট ও তার পরিবারের বিশ্রামের জায়গা।
সাংস্কৃতিক গুরুত্ব-
ফরবিডেন সিটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র নয়, বরং চীনা সংস্কৃতি, শিল্পকলা ও স্থাপত্যকলার মহামিলন।
• ছাদের হলুদ টালি সম্রাটের প্রতীক।
• ভবনের নাম ও বিন্যাসে চীনা প্রতীকবাদ ও ফেং শুই ব্যবহার করা হয়েছে।
• এখানে সংরক্ষিত রয়েছে অসংখ্য রাজকীয় শিল্পকর্ম, চীনামাটি, ক্যালিগ্রাফি, অলংকার ও ঐতিহাসিক দলিল।
১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য (World Heritage Site) ঘোষণা করে, এবং আজ এটি পৃথিবীর অন্যতম বহুল দর্শনীয় ঐতিহাসিক নিদর্শন।
বর্তমান অবস্থা-
বর্তমানে ফরবিডেন সিটি ‘প্যালেস মিউজিয়াম’ হিসেবে কোটি কোটি পর্যটকের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ এখানে এসে চীনের প্রাচীন সভ্যতা, শিল্প ও রাজকীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হন। এটি শুধু চীনের নয়, বিশ্বের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অমূল্য সম্পদ।
Leave a comment