বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ও সাহিত্যিক নূরজাহান বেগম ২০১৬ সালের ২৩ মে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি শুধু একজন সম্পাদক নন, ছিলেন এক ঐতিহাসিক আন্দোলনের প্রতীক—যে আন্দোলন ছিল নারীর কণ্ঠকে সংবাদপত্রের মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার।
১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুর জেলার চালিতাতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নূরজাহান বেগম। তার পিতা ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। মায়ের নাম ফাতেমা খাতুন। মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে মা ও মামার সঙ্গে কলকাতায় বাবার কাছে চলে যান তিনি। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠেন, যা ভবিষ্যতের জন্য ভিত্তি তৈরি করে দেয়।
কলকাতার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল ও লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে পড়াশোনার মধ্য দিয়ে তার শিক্ষা জীবন এগিয়ে চলে। উচ্চ মাধ্যমিকে দর্শন, ইতিহাস ও ভূগোল নিয়ে পাঠ শেষে ১৯৪৬ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তার সহপাঠীদের মধ্যে পরবর্তীকালে খ্যাতিমান হওয়া অনেকেই ছিলেন, যেমন—জাহানারা ইমাম ও রোকেয়া রহমান কবির।
১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই নাসিরউদ্দীনের উদ্যোগে ‘বেগম’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে। এটি ছিল ভারত উপমহাদেশের প্রথম নারীকেন্দ্রিক সাপ্তাহিক পত্রিকা। প্রথম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সুফিয়া কামাল, তবে এর সূচনালগ্ন থেকেই নূরজাহান বেগম ছিলেন পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। পরবর্তী প্রায় ছয় দশক ধরে তিনি পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন, গড়ে তোলেন নারীর জন্য এক শক্তিশালী লেখালেখির প্ল্যাটফর্ম।
ঢাকায় আসার পর তিনি ‘বেগম’ পত্রিকার মাধ্যমে নারীদের ছবি আঁকা, লেখা ও সৃজনশীলতায় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করেন। যেসব নারী লেখা পাঠাতেন, তাদের ছবি ছাপিয়ে পত্রিকাকে আরও অংশগ্রহণমূলক করে তোলেন। একসময় ‘বেগম ক্লাব’-এরও সূচনা হয়, যেখানে তিনি ছিলেন সেক্রেটারি এবং সুফিয়া কামাল উপদেষ্টা।
পত্রিকাজগতের বাইরে নূরজাহান বেগম ছিলেন এক অনন্য সংগঠক ও সমাজসেবী। তিনি ‘আপওয়া’, ‘জোনটা ইন্টারন্যাশনাল’, ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’, ‘বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদ’সহ বহু সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ৩৮ শরৎ গুপ্ত স্ট্রিটের বাড়িতে বসবাস করেন এবং সেখান থেকেই তার সাহিত্য ও সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন।
তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি লাভ করেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—বাংলাদেশ সরকারের রোকেয়া পদক (১৯৯৭), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (২০০২), আন্তর্জাতিক নারী সংগঠন ইনার হুইল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮-এর সম্মাননা (২০১০) এবং আরও অসংখ্য সন্মাননা।
৫ মে ২০১৬ তারিখে অসুস্থ অবস্থায় তাকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই ২৩ মে ২০১৬ তারিখে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার প্রয়াণে বাংলাদেশের সংবাদপত্র অঙ্গন ও নারীর অগ্রযাত্রার ইতিহাসে এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি হয়।
নূরজাহান বেগম শুধু একজন সাংবাদিক ছিলেন না; তিনি ছিলেন একটি আন্দোলনের প্রাণ, নারীর জাগরণে আলোর এক অদম্য দীপ্তি। তার কর্ম ও কণ্ঠ যুগ যুগ ধরে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
Leave a comment