সুনামগঞ্জের বিখ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণে আসা পর্যটকদের জন্য ১২টি নির্দেশনা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। দেশের অন্যতম জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ ও প্রাকৃতিক সম্পদ টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশ, প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় এসব নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। শনিবার (২১ জুন) এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায় সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন। একই দিনে হাওরের জয়পুর এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় একটি মতবিনিময় সভা, যেখানে হাওর রক্ষায় পরিবেশবান্ধব পর্যটনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলায় অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওর প্রায় ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর আয়তনের একটি জলাভূমি। এখানে রয়েছে ১০৯টি বিল, অসংখ্য খাল, নালা এবং বর্ষাকালে একত্রে বিস্তৃত জলরাশি। হাওরের উত্তর প্রান্তে রয়েছে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়, যেখান থেকে ৩৮টি ঝরনা নেমে এসে হাওরে মিলেছে। হাওরের আশপাশে বসবাস করে প্রায় ৮৮টি গ্রামের মানুষ। হাওরের বিশেষ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য একে দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত করেছে।
জেলা প্রশাসনের জারি করা ১২টি নির্দেশনায় বলা হয়েছে:
১. পর্যটকদের জন্য ব্যবহৃত নৌযান অবশ্যই প্রশাসন নির্ধারিত নৌপথ ব্যবহার করতে হবে।
২. নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পর্যটকদের লাইফজ্যাকেট পরিধান বাধ্যতামূলক।
৩. স্থানীয় গাইড ও পরিবেশনাসংক্রান্ত সেবা গ্রহণ করতে হবে।
৪. হাওরে প্লাস্টিকজাতীয় পণ্য ব্যবহার ও পরিত্যাগ নিষিদ্ধ।
৫. পাখি ও অন্যান্য প্রাণী দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে; তাদের কাছাকাছি যাওয়া যাবে না।
৬. ক্যাম্পফায়ার বা অন্য কোনোভাবে আগুন জ্বালানো নিষিদ্ধ।
৭. উচ্চ শব্দে গান বাজানো কিংবা শোনা যাবে না।
৮. হাওরের পানিতে কোনো ধরনের অজৈব বা রাসায়নিক বর্জ্য ফেলা যাবে না।
৯. মাছ ধরা, বন্যপ্রাণী শিকার বা পাখির ডিম সংগ্রহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
১০. ডিটারজেন্ট, শ্যাম্পু ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার নিষিদ্ধ।
১১. গাছ কাটা, ডাল ভাঙা বা বনজ সম্পদ সংগ্রহ নিষিদ্ধ।
১২. হাওরের সংরক্ষিত কোর জোনে প্রবেশ কিংবা মনুষ্যসৃষ্ট বর্জ্য ফেলা যাবে না।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস মিয়া বলেন, “টাঙ্গুয়ার হাওর শুধু সুনামগঞ্জ বা সিলেট বিভাগের সম্পদ নয়, এটি দেশের জাতীয় সম্পদ। তাই এখানে এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে। প্রশাসন এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে থাকবে, তবে পর্যটকদের সচেতনতা ও সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
হাওরের পরিবেশ সুরক্ষা ও স্থানীয় জনগণের স্বার্থ নিশ্চিত করতে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা শনিবার বিকেলে টাঙ্গুয়ার হাওরের জয়পুর এলাকায় একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সভায় সভাপতিত্ব করেন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা এবং সঞ্চালনায় ছিলেন সাধারণ সম্পাদক পীযূষ পুরকায়স্থ। আলোচনায় অংশ নেন টাঙ্গুয়ার হাওর সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. নূরে আলম, সাবেক সভাপতি আবদুল হালিম, খসরুল আলম, আহমদ কবির প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, হাওরে পর্যটনের কারণে স্থানীয় জনগণ কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না বরং নানাবিধ সমস্যার মুখে পড়ছেন। জলযান চলাচল, শব্দদূষণ, বর্জ্য ফেলা, বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়া ইত্যাদি কারণে হাওরের পরিবেশ প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাঁরা দাবি জানান, হাওরের মূল অংশে ইঞ্জিনচালিত নৌকা বন্ধ করে হাতে চালিত নৌকা ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হোক, যাতে করে জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং হাওরের নিস্তব্ধতা বজায় থাকে।
সভায় অংশগ্রহণকারী স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, পর্যটনের নামে হাওরের অভ্যন্তরে এমন সব কার্যক্রম হচ্ছে, যা পরিবেশ ও স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তাঁরা হাওরে পর্যটনের নিয়মকানুন কঠোরভাবে প্রয়োগের দাবি জানান এবং প্রশাসনকে সহায়তার আশ্বাস দেন।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় প্রশাসনের গৃহীত পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। তবে এসব নির্দেশনার বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকেও যুক্ত করতে হবে। শুধু নির্দেশনা জারি নয়, প্রয়োজন এর যথাযথ বাস্তবায়ন এবং পর্যটকদের মাঝে পরিবেশ-সচেতনতা বৃদ্ধিতে কার্যকর উদ্যোগ।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের মতো সংবেদনশীল জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকায় পর্যটন পরিচালনার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, আইন প্রণয়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধির সমন্বিত প্রয়াস জরুরি। তা না হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে ভবিষ্যতে হাওর এলাকায় বাস্তুতন্ত্রের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।
Leave a comment