বিদ্রোহ, মানবতা ও সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মসূচিতে স্মরণ করা হচ্ছে জাতীয় কবিকে।
আজ, ২৭ আগস্ট বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালের এই দিনে (১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) ঢাকার পিজি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তার দাফন সম্পন্ন করা হয়।
জন্ম ও শৈশব-
১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (২৪ মে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নজরুল। তার বাবা কাজী ফকির আহমেদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন। মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়ায় শৈশব থেকেই দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে তাকে। আর্থিক অনটন ও দুঃখ-দুর্দশার কারণে পরিবার ও বন্ধুবান্ধব তাকে ডাকত ‘দুখু মিয়া’।
সাহিত্য ও সঙ্গীতে বিপ্লব-
অল্প সময়েই নজরুল বাংলা সাহিত্যে ও সংগীতে অনন্য অবদান রেখে গেছেন। কবিতা, গান, প্রবন্ধ, নাটক, গল্প—প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সৃষ্টিশীলতা ছিল অসাধারণ। তার রচনায় ফুটে উঠেছে বিদ্রোহ, প্রেম, সাম্য, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা।
“বিদ্রোহী” কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি এক নতুন যুগের সূচনা করেন। তার গান ও কবিতা বাঙালি জাতিকে শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করেছে। প্রেম ও দ্রোহের অনন্য মিশ্রণে তিনি পরিচিত হন “বিদ্রোহী কবি” নামে।
মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা-
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও সঙ্গীত অপরিসীম ভূমিকা রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তার কবিতা ও গান মুক্তিকামী বাঙালিকে জাগিয়ে তুলেছিল। এছাড়া ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানেও নজরুলের রচনাগুলো ছিল প্রেরণার উৎস।
অসাম্প্রদায়িকতার পথিকৃৎ-
নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার অন্যতম পথিকৃৎ লেখক। তার রচনায় ধর্মীয় সম্প্রীতি ও মানবিকতার শক্তিশালী বার্তা পাওয়া যায়। হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ ভুলে মানবতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান করেছেন তিনি। এজন্যই তাকে বলা হয়— “মানবতার কবি”।
স্বীকৃতি ও সম্মাননা-
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুল ইসলামকে ডি-লিট সম্মাননা প্রদান করে। ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করেন। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি একুশে পদকেও ভূষিত করা হয় তাকে।
মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কর্মসূচি-
জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
• নজরুল ইনস্টিটিউট আয়োজন করেছে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী নজরুল’ শীর্ষক আলোচনা ও দোয়া মাহফিল।
• বাংলা একাডেমি কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, বিশেষ বক্তৃতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
• বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নানা কর্মসূচি পালন করছে।
সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা-
যুগ বদলালেও কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিশীলতা ও আদর্শ আজও সমান প্রাসঙ্গিক। তার অসাম্প্রদায়িকতা, মানবপ্রেম ও দ্রোহী চেতনা আজকের সমাজেও নতুন করে দিশা দেখাচ্ছে। শিক্ষাবিদ ও সাহিত্য বিশ্লেষকরা মনে করেন, তার সাহিত্যকর্ম নতুন প্রজন্মকে শোষণ, অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করছে।
বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জাতীয় জীবনে কাজী নজরুল ইসলাম কেবল একজন কবি নন, বরং মুক্তি, সাম্য ও মানবতার এক চিরন্তন প্রেরণার উৎস। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে তাকে। তার বিদ্রোহী চেতনা ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি যুগে যুগে জাতিকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে—এমনটাই মনে করেন সাহিত্যপ্রেমীরা।
Leave a comment