চট্টগ্রাম শহরের খতিবের হাট এলাকায় এক নারী ও তাঁর দুই শিশুসন্তানকে কুপিয়ে হত্যার মামলায় একমাত্র আসামি গৃহশিক্ষক তারেক চৌধুরী জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। প্রায় ১৩ বছর ধরে চলমান এই মামলায় আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান তিনি। মামলাটি বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে এবং সেখানে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্ব চলছে।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. ইকবাল হোসেন জানান, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী তারেক চৌধুরীর জামিননামা কারাগারে পৌঁছালে তা যাচাই-বাছাই করে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।
মামলার নথিপত্র থেকে জানা যায়, ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার অন্তর্গত খতিবের হাট এলাকার ‘মা-মনি ভিলা’ ভবনের পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাটে সংযুক্ত আরব আমিরাতপ্রবাসী আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী ডলি আক্তার (৩০), ছেলে মো. আলভী (৯) ও মেয়ে আদিবা পায়েল (৫) খুন হন। ডলি গৃহিণী ছিলেন এবং তাঁর দুই সন্তান বহদ্দারহাট এলাকার সাইমন লাইট গ্রামার স্কুলে পড়ত। আলভী তৃতীয় শ্রেণির ও আদিবা নার্সারির শিক্ষার্থী ছিল। তাঁদের গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন কুলগাঁও সিটি করপোরেশন কলেজের ছাত্র তারেক চৌধুরী।
ঘটনার দুদিন পর ২৫ অক্টোবর পুলিশ তারেককে গ্রেপ্তার করে এবং প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি তিনজনকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। পরে আদালতে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন। পুলিশের অপরাধ তদন্তে তারেকের ডিএনএ নমুনা ও ঘটনাস্থলে পাওয়া পায়ের ছাপ বিশ্লেষণ করে তাঁকে হত্যার সঙ্গে যুক্ত বলে নিশ্চিত হওয়া হয়। তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ সোলাইমান, বর্তমানে যিনি ওসি পদে কর্মরত, তারেককে একমাত্র আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, গৃহশিক্ষক তারেক টিউশনির বেতন কম দেওয়ায় ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং বাড়িতে ব্যবহৃত একটি দামি মুঠোফোনের লোভে হত্যাকাণ্ড ঘটান। তাঁর জবানবন্দিতে বলা হয়, ঘটনার দিন গৃহকর্ত্রী ডলি আক্তার খাবার আনতে নিচে যান, আর তাঁর মেয়ে পায়েল তখন শৌচাগারে ছিল। এই সুযোগে তারেক প্রথমে ছেলে আলভীকে কুপিয়ে হত্যা করেন। এরপর পায়েল শৌচাগার থেকে বের হলে তাকেও একই কায়দায় হত্যা করেন। পরে কিছু সময় অপেক্ষা করে ডলি আক্তার বাসায় ফিরে এলে তাকেও কুপিয়ে হত্যা করেন।
ঘটনার পর তারেক তাঁর রক্তমাখা প্যান্ট খুলে একটি লুঙ্গি পরে বাসা থেকে পালিয়ে যান। পুলিশ তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী হত্যার আলামত সংগ্রহ করে এবং হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার করে। এ মামলায় মোট ৪৪ জনকে সাক্ষী করা হয়।
একই বছরের ৩ অক্টোবর আদালত তারেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন এবং বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। মামলাটি চাঞ্চল্যকর হওয়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী এটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।
বহু বছর ধরে মামলাটির বিচারকাজ চললেও বিভিন্ন কারণে সাক্ষ্য গ্রহণে বিলম্ব ঘটে। বর্তমানে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে চলছে। তার মধ্যেই আসামি তারেক চৌধুরী জামিনে মুক্তি পেলেন।
এ বিষয়ে নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া এখনো পাওয়া যায়নি। তবে মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত আইনজীবীরা বলছেন, মামলাটি বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণেই জামিন হয়েছে।
তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আদালত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তারেক চৌধুরীকে নজরদারির মধ্যে রাখা হবে এবং মামলার বিচার প্রক্রিয়া স্বাভাবিক গতিতেই চলবে।
Leave a comment