বাংলা সংগীতের আকাশে উজ্জ্বল এক নক্ষত্র হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। মৃত্যুর এত বছর পরও তাঁর কণ্ঠের সুর আজও হৃদয় ছুঁয়ে যায় শ্রোতাদের। অথচ সেই হেমন্তের পথচলা শুরু হয়েছিল এক অদ্ভুত পরিণতি দিয়ে—গান গাওয়ার অপরাধে স্কুল থেকে বহিষ্কার হয়ে। দশম শ্রেণির ছাত্র হেমন্ত মিত্র ইনস্টিটিউশনে পড়তেন। অফপিরিয়ডে বন্ধুদের সঙ্গে কোরাস গাইতে গিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারের হাতে ধরা পড়েন তিনি। সোজা রেজিস্টার থেকে নাম কেটে বলে দেওয়া হলো—“যাও, এবার গান গেয়ে বেড়াও।” হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সহপাঠীরা, আর ভেঙে পড়ল কিশোর হেমন্তের মন।
তবে এই ঘটনার মধ্য দিয়েই তাঁর জীবনের প্রকৃত যাত্রা শুরু। সহপাঠী ও পরবর্তী সময়ে জীবনের অন্যতম প্রভাবশালী বন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের দৃঢ়তায় হেমন্তের জন্য খুলে গেল রেডিওর দরজা। সুভাষ নিজেই তাকে টেনে নিয়ে গেলেন আকাশবাণীতে অডিশন দিতে। হেমন্ত গাইলেন দরদে ভরা গান, আর সেখান থেকেই শুরু হলো অল ইন্ডিয়া রেডিওতে তাঁর আনুষ্ঠানিক সংগীতজীবন। বাবার আপত্তি, অভাব, ব্যর্থতার আশঙ্কা—সব কিছুকে পেছনে ফেলে ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন তিনি।
১৯৩৭ সালে বের হয় প্রথম রেকর্ড। তারপর একে একে বাংলা আধুনিক গান, গণসংগীত, চলচ্চিত্র—সবখানেই তিনি রেখে গেলেন স্বাক্ষর। সলিল চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর যুগলবন্দি উপহার দিল “অবাক পৃথিবী”, “পাল্কীর গান”-এর মতো কালজয়ী সৃষ্টি। হিন্দি সিনেমাতেও সমানতালে সফল হলেন তিনি, যেখানে পরিচিত ছিলেন হেমন্ত কুমার নামে। উত্তম-সুচিত্রার যুগ থেকে কিশোর কুমারের সঙ্গ পর্যন্ত বাংলা ও হিন্দি গানের ভুবন তাঁর সুরে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল।
কণ্ঠের গভীরতা, সুরের মাধুর্য আর আবেগের যাদু দিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হয়ে উঠেছিলেন শ্রোতার আপনজন। ১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়, বয়স হয়েছিল মাত্র ৬৯। কিন্তু তিনি রয়ে গেছেন অমরত্বে—“এই রাত তোমার আমার”, “আয় খুকু আয়” কিংবা “আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা”—এই গানগুলোই সাক্ষ্য দেয়, গান গাওয়ার অপরাধে বহিষ্কৃত সেই ছেলেটিই একদিন হয়ে উঠেছিলেন বাংলা গানের ইতিহাসের অনন্য অধ্যায়।
Leave a comment