গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলায় আবারও রক্ত ঝরলো। বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত একদিনের মধ্যে অন্তত ৮৫ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে কেবল নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরেই নিহত হয়েছেন অন্তত ১২ জন। তাদের মধ্যে সাত নারী ও দুই শিশুর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, চলমান যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ক্রমেই ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সংঘাতে এ পর্যন্ত ৬৫ হাজার ৪১৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন অন্তত এক লাখ ৬৭ হাজার মানুষ। এখনো অনেকের লাশ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গাজার কেন্দ্রস্থল নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে বুধবার ভোরে চালানো বিমান হামলায় মুহূর্তেই বহু ঘরবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলার সময় অধিকাংশ মানুষ ঘুমিয়ে ছিলেন। উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপ থেকে মরদেহ বের করার চেষ্টা চালালেও সরঞ্জাম ও জ্বালানির ঘাটতির কারণে কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
একজন বেঁচে যাওয়া বাসিন্দা বলেন, “আমরা প্রতিদিন মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকি। জানি না কখন বোমা এসে আমাদের বাড়ি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে।”
জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজায় পরিস্থিতি গণহত্যার পর্যায়ে পৌঁছেছে। আল-আহলি স্টেডিয়াম, যেখানে হাজারো বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল, সেখানে “রক্তাক্ত গণহত্যা”র ঘটনা ঘটেছে বলে সংস্থাটি উল্লেখ করেছে।
জাতিসংঘের অনুসন্ধান কমিশনের মতে, ইসরায়েলের সামরিক কার্যক্রম কেবল যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া নয়; বরং গাজায় স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং পশ্চিম তীরে ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করার কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ। অন্যদিকে, ইসরায়েলি সেনাপ্রধান এয়াল জামির দাবি করেছেন, গাজায় তাদের কার্যক্রম নিরাপত্তার স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে। তিনি জানান, ফিলিস্তিনিদের দক্ষিণ দিকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং গাজা সিটির বেশিরভাগ বাসিন্দা ইতোমধ্যেই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। জামির বলেন, সেনারা সেখানকার অভিযানে আরও অগ্রসর হবে এবং হামাসকে নির্মূল না করা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে যাবে।
গাজায় চলমান যুদ্ধের কারণে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। হাসপাতালগুলোতে আহতদের ঠাঁই নেই, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম ফুরিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বারবার সতর্ক করলেও প্রয়োজনীয় সাহায্য পৌঁছাতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজার জনগণ এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়, খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা—সব ক্ষেত্রেই চরম সংকট দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, গাজায় বর্তমানে কয়েক লাখ শিশু মারাত্মক অপুষ্টি ও মানসিক আঘাতের শিকার।
ইসরায়েলের এ কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। তবে কূটনৈতিক অচলাবস্থা কাটছে না। যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু পশ্চিমা দেশ ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখায় যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এ হামলাকে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করছে। তারা বলছে, আন্তর্জাতিক আদালতে এ ধরনের অপরাধের বিচার হওয়া উচিত।
গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলায় প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে মৃত্যুর মিছিল। একদিকে সেনা অভিযানের নামে নিরীহ মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক কূটনীতির জটিলতায় যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হচ্ছে। মানবিক বিপর্যয় এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ।
Leave a comment