রাজশাহীতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন অভ্যন্তরীণ সংকটে জর্জরিত। সদ্য অনুমোদিত জেলা সমন্বয় কমিটি গঠনের মাত্র আট দিনের মাথায় একদিকে প্রধান সমন্বয়কারী পদত্যাগ করেছেন, অন্যদিকে ১ নম্বর যুগ্ম সমন্বয়কারীকে দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে মারধরের ঘটনার জেরে। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও আস্থার সংকটের কারণে দলের কর্মসূচি ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে স্থানীয় বিরোধ মেটাতে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে।
গত ১৮ জুন রাজশাহী জেলা এনসিপির সমন্বয় কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়। কমিটি গঠনের আট দিনের মাথায়, ২৬ জুন বৃহস্পতিবার রাতে, জেলার প্রধান সমন্বয়কারী রাশেদুল ইসলাম কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান। পরদিন, ২৭ জুন শুক্রবার, মারধরের অভিযোগে নাহিদুল ইসলাম নামের অপর এক নেতা সাময়িকভাবে অব্যাহতি পান এবং তাঁর বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়।
পদত্যাগপত্রে রাশেদুল ইসলাম লেখেন, “এনসিপির ব্যানারে দলের সেবা করা এবং দেশের উন্নতির জন্য কাজ করা আমার জন্য সম্মানের এবং সৌভাগ্যের। তবে ব্যক্তিগত কারণে আমি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে এই মুহূর্তে আমাকে আমার ভূমিকা থেকে সরে দাঁড়াতে হবে।” তবে শুক্রবার রাতে তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, “ঘটনাটি আমাকে মানসিকভাবে দুঃস্থ করেছে। রাজনীতি আমার জন্য নয়। আমি এখনো এনসিপির সঙ্গে আছি, তবে নেতৃত্বে থাকার উপযোগী নয় মনে করছি।”
এই বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত বুধবার রাতে রাজশাহীর একটি রেস্তোরাঁয়। জেলা এনসিপির শীর্ষ নেতারা সেদিন বৈঠকে বসেন। ওই রেস্তোরাঁটির মালিক ছিলেন পদত্যাগী সমন্বয়কারী রাশেদুল ইসলাম। প্রত্যক্ষদর্শী ও দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ওই সভায় জেলা এনসিপির ১ নম্বর যুগ্ম সমন্বয়কারী নাহিদুল ইসলাম হঠাৎ অন্য যুগ্ম সমন্বয়কারী ফিরোজ আলমকে বুকে লাথি মারেন। দুইজনই একে অপরকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে রাজশাহীতে ‘পুনর্বাসনের’ অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। মারধরের পর ফিরোজ আলমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এই ঘটনার পর কেন্দ্রীয় কমিটি নাহিদুল ইসলামকে তাৎক্ষণিকভাবে অব্যাহতি দেয় এবং তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেয়। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাঁর স্থায়ী বহিষ্কারের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হয়নি।
এদিকে, শুক্রবার বিকেলে এক ভিডিও বার্তায় নাহিদুল ইসলাম দাবি করেন, “জেলা কমিটিতে কিছু বিতর্কিত ব্যক্তি আছে, যারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছেন। এর প্রতিবাদ করায় আমার বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।” একই ভিডিও বার্তায় তিনি নিজেকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর রাজশাহী জেলা আহ্বায়ক হিসেবেও পরিচয় দেন।
দলের অভ্যন্তরে এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে শুক্রবার রাতেই রাজশাহীতে পৌঁছান কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন। তিনি বলেন, “আমি সবার সঙ্গে কথা বলেছি। আজ রাতেও আবার বসব। আশা করছি, দলীয় ঐক্য ফিরিয়ে আনার পথ খুঁজে বের করা যাবে। রাজশাহীতে এনসিপির কার্যক্রম অগ্রসর হচ্ছে, এবং আমরা সম্মিলিতভাবে দলের ভেতরকার সমস্যার সমাধান করব।”
তবে দলের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার কারণে এরই মধ্যে রাজশাহীতে এনসিপির কার্যক্রমে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেনের ওপর ককটেল হামলার প্রতিবাদে রাজশাহীতে ডাকা কর্মসূচিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা উপস্থিত ছিলেন না। জেলা ও মহানগর মিলিয়ে ৪৩ জন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা থাকা সত্ত্বেও বিক্ষোভে অংশ নেন মাত্র ২৭ জন। মূলত জেলা ও মহানগর কমিটির মধ্যে দূরত্ব এবং পারস্পরিক আস্থাহীনতা কর্মসূচির সফলতা ব্যাহত করেছে বলে স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
মহানগর কমিটি যদিও জেলার সঙ্গে বিরোধ অস্বীকার করেছে, তবুও নেতাদের উপস্থিতির অভাব এবং দলের অভ্যন্তরীণ অভিযোগ–বিরোধের বাস্তবতা অস্বীকার করা যাচ্ছে না। বরং মারধরের মতো অস্বাভাবিক ঘটনা এবং পদত্যাগ-অব্যাহতির পরম্পরা দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতাকেই সামনে এনে দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এনসিপির মতো একটি নবীন দলের জন্য রাজশাহীর মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরে নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বড় ধরনের ক্ষতির ইঙ্গিত বহন করে। সংগঠনের মূল শক্তি হলো অভ্যন্তরীণ সংহতি ও শৃঙ্খলা। যেখানে এক মাসের মধ্যেই মারধর, পদত্যাগ ও কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের মতো ঘটনা ঘটে, সেখানে দলীয় নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
তবে আশার কথা, দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। পদত্যাগপত্র এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়নি, বরং ‘বিবেচনাধীন’ হিসেবে রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিনিধি রাজশাহীতে এসে নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। ফলে একটি সমঝোতার সম্ভাবনা এখনো উন্মুক্ত রয়েছে।
রাজশাহী এনসিপির সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দলটির সাংগঠনিকভাবে সুসংহত হওয়ার প্রয়োজনীয়তাকেই সামনে এনেছে। নেতৃত্বের প্রশ্নে স্বচ্ছতা, শৃঙ্খলা এবং দলে অবস্থান নেওয়া প্রতিটি নেতার প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত না হলে ভবিষ্যতে এমন সংকট আরও গভীর হতে পারে। এখন দেখার বিষয়—এই সংকটের মধ্য থেকে দল কীভাবে পুনরুদ্ধার করে নিজেদের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করে তোলে।
Leave a comment