পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে দীর্ঘদিনের টানাপোড়েনের মধ্যেই ইরান নতুন করে তার পরমাণু শক্তি কর্মসূচিকে এগিয়ে নিতে যাচ্ছে। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত পরমাণু শক্তি সংস্থা জানিয়েছে, রাশিয়া ইরানে মোট আটটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সম্মিলিতভাবে প্রায় ২০ গিগাওয়াট বা ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ এসলামি রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম ‘ইরনাকে’ দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, মস্কোর প্রস্তাবিত এই পরিকল্পনায় তেহরান সম্মতি দিয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরের লক্ষ্যে তিনি বর্তমানে রাশিয়ায় সরকারি সফরে আছেন এবং চলতি সপ্তাহেই এ সংক্রান্ত সমঝোতায় পৌঁছানো হবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বহুদিন ধরেই পশ্চিমা বিশ্বে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইরানের কাছে বর্তমানে প্রায় ৪০০ কেজি ইউরেনিয়াম মজুত রয়েছে, যার বিশুদ্ধতা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করা হয়েছে।
পরমাণু বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি ইউরেনিয়ামের বিশুদ্ধতা ৯০ শতাংশে উন্নীত করা যায়, তবে তা দিয়ে সহজেই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করা সম্ভব। আর এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো ইরানের কর্মসূচি নিয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
আইএইএ প্রতিবেদন প্রকাশের মাত্র ছয় দিনের মাথায় ইসরায়েল ইরানে বিমান হামলা চালায়। পরে সেই অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রও যোগ দেয়। টানা ১২ দিনের অভিযানে ইরানের একাধিক পরমাণু স্থাপনায় উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে অভিযানের পর থেকে ইরানের হাতে থাকা উচ্চমাত্রার ইউরেনিয়ামের অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার সহায়তায় নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ইরানের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। একদিকে দেশটি অভ্যন্তরীণ জ্বালানি চাহিদা মেটাতে পারবে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনীতিতে প্রভাব বাড়াতে পারবে।
রাশিয়ার জন্যও এই প্রকল্প তাৎপর্যপূর্ণ। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত মস্কো মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার ও কৌশলগত মিত্রতা জোরদারের অংশ হিসেবে ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই উদ্যোগ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক আরও উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলবে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এ চুক্তিকে হুমকি হিসেবে দেখবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে চীন ও রাশিয়ার মতো দেশগুলো ইরানের পাশে দাঁড়াতে পারে, যা বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করবে।
ইরান-রাশিয়ার এই পরমাণু চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি ও বৈশ্বিক নিরাপত্তায় নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। ইরান বলছে, তাদের উদ্দেশ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে সীমাবদ্ধ। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের আশঙ্কা, এই কর্মসূচি গোপনে অস্ত্র উন্নয়নের দিকেই ধাবিত হতে পারে। ভবিষ্যতে এ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে কিনা, তা নির্ভর করছে রাশিয়া-ইরান জোট কতটা কার্যকরভাবে এগোতে পারে এবং পশ্চিমা বিশ্ব কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানায় তার ওপর।
Leave a comment