মরুভূমি মানেই রুক্ষ, তপ্ত আর প্রাণহীন ধূসর প্রান্তর—এমন ধারণা অনেকের। কিন্তু প্রকৃতি তার বিস্ময়কর বৈচিত্র্য লুকিয়ে রেখেছে এখানেও। কঠোর গরম, পানির অভাব এবং কঠিন মাটির ভেতরেও কিছু উদ্ভিদ আশ্চর্য সহিষ্ণুতা নিয়ে টিকে থাকে। শুধু বেঁচেই থাকে না, কখনো সৌন্দর্যে, কখনো ঔষধি গুণে কিংবা কখনো আকার-গঠনের অভিনবত্বে তারা মানুষকে বিস্মিত করে তোলে।
চলুন, জেনে নিই মরুভূমির এমন কিছু অদ্ভুত ও বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদের গল্প।
ওলেমি পাইন: জীবন্ত জীবাশ্ম
অস্ট্রেলিয়ার মরু অঞ্চলে পাওয়া যায় ওলেমি পাইন, যাকে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন উদ্ভিদ বলা হয়। প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর ধরে টিকে থাকা এই গাছকে বিজ্ঞানীরা “জীবন্ত জীবাশ্ম” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শূন্যের নিচে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ঠাণ্ডায়ও এরা বেঁচে থাকতে পারে। কাণ্ডে বুদবুদ আকৃতির গঠন গাছটিকে আলাদা সৌন্দর্য দিয়েছে।
ড্রাগন ব্লাড ট্রি: লাল রসের রহস্য
ইয়েমেনের সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জের প্রতীক ড্রাগন ব্লাড ট্রি শুধু দেখতে নয়, বৈশিষ্ট্যেও অনন্য। প্রাগৈতিহাসিক এই গাছের পাতাগুলো ছাতার মতো একত্রিত হয়ে ছায়া তৈরি করে। পাতায় জমা শিশির থেকে পানি সংগ্রহ করে গাছটি বেঁচে থাকে। এর লাল আঠাজাত রস একসময় ওষুধ ও রঙ তৈরিতে ব্যবহৃত হতো এবং আন্তর্জাতিকভাবে রপ্তানি করা হতো। তবে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণের কারণে গাছটির অস্তিত্ব এখন সঙ্কটে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, ২০৮০ সালের মধ্যে প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
বেসবল গাছ: প্রকৃতির সবুজ বল
দক্ষিণ আফ্রিকার কারু মরুভূমিতে জন্মানো এই ছোট্ট গাছটির ব্যাস মাত্র ১৫ সেন্টিমিটার, দেখতে অনেকটা সবুজ বেসবলের মতো। সায়াথিয়া নামের এই উদ্ভিদটির সৌন্দর্যের কারণে সংগ্রাহকদের মধ্যে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে অতিরিক্ত সংগ্রহ ও বাণিজ্যিক আগ্রহের কারণে এটি দ্রুত বিলুপ্তির পথে।
ডেজার্ট উইলো ট্রি: ফুলের সৌন্দর্যে ভরা
যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর মরু অঞ্চলে জন্মানো ডেজার্ট উইলো বা চিলোপসিস গাছটি রঙিন ফুলের জন্য বিখ্যাত। মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফুটে থাকা এর গোলাপি-ল্যাভেন্ডার ফুল মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়ন হয়। হলুদ ও বেগুনি ছোপে ভরা ফুলগুলো মরুভূমিকে রঙিন করে তোলে।
আয়রনউড: মরুভূমির দীর্ঘজীবী দানব
উত্তর আমেরিকার সোনোরান মরুভূমিতে পাওয়া যায় আয়রনউড গাছ। ধীরগতিতে বেড়ে উঠলেও এর আয়ু আশ্চর্যজনকভাবে দীর্ঘ—প্রায় ১,৫০০ বছর পর্যন্ত। এপ্রিল মাসে ফুল ফোটে এই গাছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো, আশপাশের পরিবেশে তাপমাত্রা প্রায় ১৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত কমানোর ক্ষমতা রাখে এ গাছ।
এলিফ্যান্ট ট্রি: পানির ভাণ্ডার
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আনজা-বোরিওগো মরুভূমি ও অ্যারিজোনার কিছু অঞ্চলে জন্মায় এলিফ্যান্ট ট্রি। পুরু গুঁড়ির ভেতর পানি জমিয়ে রাখার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে এতে। ছোট আকারের এই গাছ তারকা আকৃতির সাদা ফুলে ভরে ওঠে। শীত ও খরায় পাতা ঝরালেও মরে যায় না।
ব্যারেল ক্যাকটাস: মরুর কাঁটা দানব
দক্ষিণ-পশ্চিম আমেরিকার মরুতে পাওয়া যায় বিশাল ব্যারেল ক্যাকটাস, যেটি ১০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। কাঁটাগুলো চার ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো—মাটি থেকে তুলে নিলেও এটি ঘরে ছয় বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। প্রায় ১৫০ বছর পর্যন্ত আয়ু নিয়ে মরুভূমির কঠিন পরিবেশেও এটি ফুল ফোটায়।
ডেজার্ট লিলি: সৌন্দর্যের প্রতীক
হেসপারোকয়ালিস নামেও পরিচিত এই উদ্ভিদটি উত্তর আমেরিকা, মেক্সিকো ও ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমিতে জন্মে। মার্চ থেকে মে পর্যন্ত ফানেল আকৃতির ক্রিম রঙের ফুলে ভরে ওঠে এ গাছ। মোটা মূল স্থানীয়দের কাছে সুস্বাদু খাদ্য হিসেবেও জনপ্রিয়।
সিলভার টর্চ ক্যাকটাস: উলি সৌন্দর্য
বলিভিয়া ও আর্জেন্টিনার এই ক্যাকটাসকে বলা হয় উলি টর্চ। তিন মিটার লম্বা এই গাছের গায়ে দুই ইঞ্চি দীর্ঘ কাঁটা ছড়িয়ে থাকে। গরমকালের শেষে ফুটে ওঠা ফুলগুলো সাধারণ চোখে ফুল বলে মনে নাও হতে পারে, তবে এগুলো মরুভূমির সৌন্দর্যে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।

মরুভূমির সবুজ রহস্য
প্রকৃতির কঠিনতম পরিবেশে এসব উদ্ভিদ শুধু টিকে থাকে না, বরং বৈশিষ্ট্যে ভরপুর অনন্যতা প্রদর্শন করে। কেউ পানি সংরক্ষণ করে, কেউ ঠাণ্ডা পরিবেশ তৈরি করে, কেউ আবার ওষুধ ও খাদ্যের উৎস হয়ে ওঠে। মরুভূমির এই বিস্ময়কর উদ্ভিদগুলো প্রমাণ করে যে, জীবনের জন্য বৈরী পরিস্থিতিও কখনো বাধা হতে পারে না। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো- মানুষের লোভ, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণের কারণে এদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। প্রকৃতির এই অমূল্য ধন রক্ষায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, নইলে আগামী প্রজন্ম হয়তো মরুভূমির এই বিস্ময়গুলো শুধু বইয়ের পাতায় কিংবা ছবিতে দেখেই চিনবে।







Leave a comment