দেশজুড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আবারও বাড়ছে। চলতি জুন মাসে প্রতিদিন গড়ে ১০০-এর বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, তবে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩৫২ জন নতুন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে একজন নারী মারা গেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম শনিবার (২১ জুন) বিকেলে এ তথ্য জানিয়েছে।
ডেঙ্গুতে নতুন আক্রান্ত ৩৫২ জনের মধ্যে ১৬৭ জনই বরিশাল বিভাগের বাসিন্দা। বিশেষভাবে বরগুনা জেলার পরিস্থিতি সবচেয়ে উদ্বেগজনক। শুধু বরগুনা সদর হাসপাতালে শুক্রবার সকাল থেকে শনিবার বিকেল পর্যন্ত ৬৩ জন নতুন রোগী ভর্তি হন। বর্তমানে সেখানে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২২১। এই পরিস্থিতিকে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ নজিরবিহীন বলেও অভিহিত করেছে।
হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার জানিয়েছে, শনিবার যিনি মারা গেছেন, তিনি কুমিল্লার বরুড়ার নলুয়া গ্রামের বাসিন্দা। ২৫ বছর বয়সী এই নারী কুমিল্লা ট্রমা সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। চলতি বছর ডেঙ্গুতে এই নিয়ে ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই নারী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন মাসে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৮৪ জন ডেঙ্গু রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা ও ঝালকাঠির বাসিন্দা। তবে ঢাকা ও চট্টগ্রামেও রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানা গেছে।
এদিকে জনস্বাস্থ্যবিদদের একাংশ মনে করছেন, সরকারি পরিসংখ্যান পুরো চিত্র তুলে ধরছে না। অনেক রোগী বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন অথবা ব্যক্তিগত ক্লিনিকে ভর্তি হচ্ছেন, যাদের তথ্য সরকারিভাবে নথিভুক্ত হচ্ছে না। ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ক্ষেত্রেও একই সমস্যা দেখা যাচ্ছে। যেমন বরগুনায় স্থানীয় সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত ১১ জন মারা গেছেন, অথচ সরকারিভাবে দেখানো হচ্ছে মাত্র ৫ জন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। কারণ, এ সময় মশা বংশবিস্তার করে দ্রুত। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের পাশাপাশি এখন গ্রামাঞ্চলেও এডিস মশার বিস্তার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কার্যকরতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
এদিকে বরিশাল ও বরগুনার স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংকট দেখা দিচ্ছে। রোগীর চাপ সামলাতে স্টাফ সংকটে চিকিৎসার গুণগত মানও প্রশ্নের মুখে পড়ছে। বরগুনা সদর হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, “আমরা প্রতিদিনই নতুন রোগী পাচ্ছি। অনেকে দেরিতে আসছেন, তখন প্লেটলেট কমে যাচ্ছে, অবস্থা জটিল হয়ে যায়।”
এ অবস্থায় জনস্বাস্থ্যবিদেরা শহর ও গ্রামে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো, ডেঙ্গু প্রতিরোধে গণসচেতনতা বাড়ানো এবং স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবীদের সম্পৃক্ত করে দ্রুত ও সার্বজনীন মশা নিধন কর্মসূচি হাতে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করতে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিশেষ অভিযান চালানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যবস্থা আরও জোরদার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, সময়মতো চিকিৎসা ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও পানি পান করলে ডেঙ্গু থেকে সুস্থ হওয়া সম্ভব। তবে সতর্কতা হিসেবে জ্বর হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বার্তা একটাই—ডেঙ্গু প্রতিরোধে দরকার সম্মিলিত সচেতনতা এবং সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা।
Leave a comment