
বিশ্বের অন্যতম আলোচিত ও হৃদয়বিদারক সমুদ্র দুর্ঘটনা টাইটানিক ডুবি নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক বিদ্যমান। তবে সম্প্রতি কিছু বিকল্প ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মতামতে এই ঘটনার পেছনে গভীর ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা আবারও জোরালো হয়ে উঠেছে। তাদের দাবি অনুযায়ী, ১৯১২ সালের ১৫ই এপ্রিল ডুবে যাওয়া ‘আরএমএস টাইটানিক’ আদতে টাইটানিক ছিল না; বরং White Star Line-এর আরেক জাহাজ ‘Olympic’ ছিল মূলত এই বিপর্যয়ের মূল চরিত্র।
বিকল্প ইতিহাসবিদ রবিন গার্ডিনার তাঁর আলোচিত গ্রন্থ “Titanic: The Ship That Never Sank?”-এ বলেন, টাইটানিক ও অলিম্পিক ছিল প্রায় অভিন্ন দুটি জাহাজ। ১৯১১ সালে একটি দুর্ঘটনায় Olympic মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বিমা সংস্থা ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করে। এরপর White Star Line কোম্পানি নাকি Olympic-কে টাইটানিকের রূপে রঙ করে সমুদ্রে পাঠায়, উদ্দেশ্য—পূর্বপরিকল্পিতভাবে ডুবিয়ে বিমা অর্থ উদ্ধার করা।
এই তত্ত্বের সমর্থনে গবেষকরা বিভিন্ন ধরনের তথ্য তুলে ধরেন:
– টাইটানিকের কিছু কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য ও যন্ত্রাংশ নাকি Olympic-এর সাথে বেশি মেলে।
– জীবিত যাত্রী ও কর্মীদের কিছু বিবরণে অমিল পাওয়া গেছে।
– বিমা নীতির অঙ্কে রহস্যজনক পরিবর্তন হয় জাহাজ ডোবার ঠিক আগে।
তবে মূলধারার ইতিহাসবিদরা এই দাবিকে সরাসরি উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের মতে, টাইটানিক ও অলিম্পিকের নির্মাণে যথেষ্ট পার্থক্য ছিল, যার প্রমাণ রয়েছে নির্মাণ পরিকল্পনা, প্রতক্ষ্যদর্শীদের বয়ান ও জাহাজ নির্মাণ সংশ্লিষ্ট নথিতে। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, ১৯১২ সালের এপ্রিল মাসে টাইটানিক সত্যিকারভাবেই একটি আইসবার্গে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায়।
তবে বিতর্ক এখানেই শেষ হয় না। কিছু গবেষক ‘টাইটানিক’ দুর্ঘটনার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা (Federal Reserve System) প্রতিষ্ঠার মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি করেন। তাদের মতে, টাইটানিক ছিল একটি ‘অর্থনৈতিক বিপ্লব’ বা economic coup d’état–এর কুশলী যন্ত্র।
প্রমাণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন, টাইটানিকের যাত্রী তালিকায় ছিলেন ধনকুবের ও প্রভাবশালী তিন ব্যক্তি—John Jacob Astor IV, Isidor Straus, ও Benjamin Guggenheim। এরা সবাই ফেডারেল রিজার্ভ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করতেন। আশ্চর্যজনকভাবে, তাঁরা তিনজনই টাইটানিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। অপরদিকে, J.P. Morgan, যিনি White Star Line ও Titanic প্রকল্পের নেপথ্য অর্থদাতা ছিলেন, যাত্রার ঠিক আগে অসুস্থতার অজুহাতে যাত্রা বাতিল করেন।
এর ঠিক এক বছরের মাথায়, ১৯১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর, যখন অধিকাংশ কংগ্রেসম্যান ছুটিতে ছিলেন, Federal Reserve Act পাশ হয়। এরপর Rothschild, Rockefeller, Warburg ও Schiff পরিবারের নিয়ন্ত্রণে আসে আমেরিকার মুদ্রানীতি। এভাবেই একগুচ্ছ প্রভাবশালী পরিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা দখল করে নেয় বলে অভিযোগ করেন এই তত্ত্বের প্রবক্তারা।
এই ঘটনার পেছনে আরও এক চাঞ্চল্যকর উপাদান তুলে ধরা হয়—১৯১০ সালে জর্জিয়ার Jekyll Island-এ এক গোপন সভা, যেখানে আলোচনায় অংশ নেন Rothschild, Rockefeller, Warburg ও Schiff পরিবারের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক মিত্ররা। পরিকল্পনা ছিল: একটি বেসরকারি কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হবে, যার নাম হবে ‘Federal Reserve’। তবে তা জনসাধারণের কাছে ‘সরকারি’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রচার করা হবে।
বইগুলোতে (যেমন: G. Edward Griffin-এর “The Creature from Jekyll Island”) দাবি করা হয়, Titanic দুর্ঘটনার পেছনে এই কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিরোধীদের সরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য কাজ করেছে। এমনকি দাবি করা হয়, এই আর্থিক শক্তির নেটওয়ার্ক ভবিষ্যতের ইসরায়েল রাষ্ট্র, বালফোর ঘোষণা (১৯১৭), এবং বিশ্বযুদ্ধের অর্থায়ন-এর সাথেও গভীরভাবে যুক্ত ছিল।
রহস্য আরো ঘনীভূত হয় যখন জানা যায়, Jacob Schiff নাকি রুশ বিপ্লবে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করেছিলেন, কারণ রোমানোভ সাম্রাজ্য ছিল জায়োনিস্ট রাষ্ট্র গঠনের বিরুদ্ধে। ফলে টাইটানিক দুর্ঘটনাকে একক দুর্ঘটনা হিসেবে দেখা যায় না, বরং এক বৃহৎ ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাসের সূক্ষ্ম চাল হিসেবে চিত্রিত করা হয়।
অবশ্য এই তত্ত্বগুলো নিয়ে মূলধারার গবেষকরা গভীর সন্দেহ পোষণ করেন এবং এগুলোকে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। তাদের মতে, Titanic ছিল প্রকৃতপক্ষে এক ট্র্যাজিক দুর্ঘটনা, না যে এর সাথে কোন ধরণের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ‘প্লট’ ছিল।
তবে যেটাই হোক—একটি বিষয় স্পষ্ট, ১৯১২ সালের এপ্রিল রাতে আটলান্টিক মহাসাগরে শুধু একটি জাহাজই ডুবেনি, ডুবে গিয়েছিল বহু প্রশ্ন, বহু সম্ভাব্য সত্য এবং এক রহস্যময় অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল, যার উত্তর আজও ইতিহাসের গহীনে গুম হয়ে আছে।
তথ্যসূত্র:
– Robin Gardiner, Titanic: The Ship That Never Sank?
– G. Edward Griffin, The Creature from Jekyll Island
– Titanic Inquiry Project
– Secrets of the Federal Reserve – Eustace Mullins
– Federal Reserve History Archives
– British Library Archives: Balfour Declaration
– অন্যান্য ঐতিহাসিক দলিল ও সাক্ষ্য
Leave a comment