বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সম্ভাব্য পরিবর্তন আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা একটানা ৪৪ বছরের বেশি সময় ধরে নেতৃত্বে আছেন। তবে বয়স, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং নির্বাসিত জীবনের প্রেক্ষাপটে এখন তিনি উত্তরাধিকার পরিকল্পনার দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
উত্তরাধিকার পরিকল্পনা ও পরিবারের ভূমিকা-
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেখ হাসিনা তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে আনার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছেন। এছাড়া শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যেতে পারে।
এটি ভারতের কংগ্রেসের নেতৃত্ব কাঠামোর সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে, যেখানে সোনিয়া গান্ধীর সন্তান রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ধীরে ধীরে দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন।
সজীব ওয়াজেদ ও সায়মা ওয়াজেদের ভিন্ন ভূমিকা-
সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন এবং মায়ের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন। মিডিয়ায় ঘন ঘন সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন এবং দলের ভাবমূর্তি বিদেশে তুলে ধরছেন।
অন্যদিকে দিল্লিতে অবস্থানরত সায়মা ওয়াজেদ সরাসরি মায়ের সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বক্তৃতা, কর্মসূচি এবং বৈঠকের প্রস্তুতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। বাইরের দর্শনার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাতের ক্ষেত্রেও তার দায়িত্ব বেড়েছে।
কেন রাজনীতিতে ফিরলেন সায়মা ওয়াজেদ?
মাত্র কয়েক মাস আগেও তিনি ছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক। কিন্তু বাংলাদেশের আপত্তি এবং বিভিন্ন অভিযোগের কারণে তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটিতে পাঠানো হয়। এতে তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার কার্যত থেমে যায় এবং তিনি পুরোপুরি রাজনীতিতে মনোনিবেশ করতে শুরু করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজনৈতিক পোস্ট দেওয়া শুরু করেছেন, যা তার নতুন ভূমিকাকে আরও স্পষ্ট করে তুলছে।
দলের ভেতরে প্রতিক্রিয়া-
আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা অনানুষ্ঠানিকভাবে উত্তরাধিকার পরিকল্পনার কথা স্বীকার করলেও প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আরাফাত দাবি করেছেন, “সাকসেসন প্ল্যান এখন দলের অগ্রাধিকারে নেই। আমাদের মূল লক্ষ্য বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার।” তবে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, দলের কার্যক্রমে জয় ও পুতুল দুজনই এখন যুক্ত আছেন।
কংগ্রেস মডেল থেকে অনুপ্রেরণা-
ভারতে রাহুল গান্ধীকে সামনে রেখে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সহযোগীর ভূমিকায় থাকেন। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও জয়কে সামনে রেখে পুতুলকে সহায়ক ভূমিকায় দেখা যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পরিবারকেন্দ্রিক দলের জন্য এটাই স্বাভাবিক পথ।
ওবায়দুল কাদেরের গুরুত্বহ্রাস ও নতুন ত্রয়ী-
বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। পরিবর্তে তিন নেতা – আসাদুজ্জামান খান কামাল, আ.ফ.ম. বাহাউদ্দিন নাসিম ও জাহাঙ্গীর কবির নানক – কলকাতায় অবস্থান করে দলীয় কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তাদের সঙ্গে সমন্বয় করছেন সায়মা ওয়াজেদ।
সবচেয়ে কঠিন সময় অতিক্রম করছে আওয়ামী লীগ-
দলের কার্যক্রম বর্তমানে তিন ভৌগোলিক কেন্দ্রে বিভক্ত – দিল্লিতে শেখ হাসিনা ও সায়মা ওয়াজেদ, যুক্তরাষ্ট্রে জয় এবং কলকাতায় শীর্ষ নেতাদের একটি অংশ। ৭৬ বছরের পুরনো এই দলটি সবচেয়ে বড় সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ থাকছে শেখ হাসিনার পরিবারের হাতেই।
Leave a comment