বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক সংস্কারের অগ্রদূত, শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ আর নেই। বুধবার (৮ অক্টোবর) রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।
তার মৃত্যুর বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন মেয়ের জামাই সারোয়ার জাহান। তিনি জানান, ড. তোফায়েল আহমেদ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। চিকিৎসকেরা তার হার্টে রিং পরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এমন সময়ই তার মৃত্যু ঘটে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. তোফায়েল আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণার অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। দেশের বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় প্রশাসন ও অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা নিয়ে তার তত্ত্ব, বিশ্লেষণ ও দিকনির্দেশনা এক প্রজন্মের নীতি-নির্ধারক ও গবেষকদের অনুপ্রাণিত করেছে।
তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন রাজনীতি ও প্রশাসন বিভাগে অধ্যাপনা করেন। কর্মজীবনের শুরুতে যোগ দেন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে (বার্ড), যেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এবং গ্রামীণ উন্নয়ন মডেল বাস্তবায়নে অবদান রাখেন।
২০২৪ সালের অক্টোবরে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের’ সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক তোফায়েল। পরবর্তীতে তাকে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তিনি এই দায়িত্বে থেকে প্রশাসনিক কাঠামো সংস্কার, স্থানীয় সরকারের কার্যকর বিকেন্দ্রীকরণ, এবং জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা গঠনে নীতিগত প্রস্তাবনা দেন। তার গবেষণা ও সুপারিশগুলো আজও প্রশাসনিক সংস্কার আলোচনায় দিকনির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত।
ড. তোফায়েল আহমেদ ১৯৫৫ সালের ৪ মে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ফতেহাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম কলেজ থেকে যথাক্রমে এসএসসি ও এইচএসসি সম্পন্ন করেন।
পরবর্তীতে ১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি ও প্রশাসনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি যুক্তরাজ্যে যান এবং ১৯৮১ সালে সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Social Sector Planning and Management-এ দ্বিতীয় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।পরে ১৯৯১ সালে উন্নয়ন অধ্যয়নে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তার গবেষণার মূল বিষয় ছিল বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার কাঠামোর বিকেন্দ্রীকরণ ও অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থার কার্যকারিতা।
অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে তৃণমূল থেকে শক্তিশালী করার পক্ষে ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, গণতন্ত্রের প্রকৃত বিকাশ তখনই সম্ভব, যখন স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। তিনি একাধিক গবেষণা প্রবন্ধ, বই ও নীতিনির্ধারণমূলক প্রস্তাবনা লিখেছেন, যার অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি নীতিমালা প্রণয়নে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য প্রকাশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে “Local Government and Decentralization in Bangladesh”, “Democracy and Development at the Grassroots” ইত্যাদি।
ড. তোফায়েলের মৃত্যুতে শিক্ষা, প্রশাসন ও গবেষণা মহলে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাবেক সহকর্মীরা জানিয়েছেন, তিনি ছিলেন বিনয়ী, চিন্তাশীল ও নীতিনিষ্ঠ এক ব্যক্তিত্ব। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদরা বলেছেন, “ড. তোফায়েল আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রাণপুরুষ। তার চিন্তা ও নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দিকনির্দেশনা হয়ে থাকবে।”
Leave a comment