বাংলাদেশের সঙ্গে সব ধরনের দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে আলোচনার জন্য অনুকূল পরিবেশে প্রস্তুত থাকার কথা জানিয়েছে ভারত। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেন, দুই দেশের মধ্যে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আলোচনার জন্য দীর্ঘদিন ধরে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত কূটনৈতিক কাঠামো বিদ্যমান রয়েছে। বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এই মন্তব্য করেন তিনি।
ভারতীয় পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বিশ্লেষণ ও সুপারিশ প্রস্তুতির প্রাক্কালে এই বক্তব্য সামনে এল। জানা গেছে, বৈঠকে অংশ নেবেন ভারতের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিব শংকর মেনন, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল আতা হাসনাইন, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাস এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমিতাভ মাত্তু।
এই আলোচনার প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা। ২০২৪ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর গঠিত অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম, ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে প্রশ্ন তুলতে পারেন ভারতের সংসদ সদস্যরা। বিশেষ করে এই অস্থিরতা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তার জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তা নিয়েও আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।
গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি নবায়নের বিষয়ে এক প্রশ্নে মুখপাত্র জয়সোয়াল বলেন, “আমরা সব সময় বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বিশ্বাসী। তবে তা হতে হবে পারস্পরিক স্বার্থ ও সম্মানের ভিত্তিতে এবং একটি অনুকূল পরিবেশে।”
সম্প্রতি চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এক ত্রিপক্ষীয় বৈঠক প্রসঙ্গে রণধীর জয়সোয়াল বলেন, “আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে যেসব কূটনৈতিক বা কৌশলগত ঘটনা ঘটছে, তা আমরা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছি। এসব পরিস্থিতি ভারতের নিরাপত্তা ও স্বার্থের ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব আমাদের রয়েছে। আমরা প্রতিটি দেশের সঙ্গে স্বাধীনভাবে সম্পর্ক গড়ি, তবে ওই সম্পর্কের প্রেক্ষাপট মূল্যায়ন করি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার দৃষ্টিকোণ থেকে।”
বিশেষজ্ঞদের মধ্য থেকে সংসদীয় কমিটিকে এমন পরামর্শ দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যে, বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ভারতকে সমন্বিত কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে।
এ ছাড়া, ভারতের গণমাধ্যম ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণের একটি সাধারণ ধারণা নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মনে করেন ভারত অতীতে শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষ নিয়েছে এবং জনগণের মতামতের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। এই মনোভাব কিভাবে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে প্রভাবিত করছে, সেটিও সংসদীয় কমিটিকে ব্যাখ্যা করবেন তাঁরা।
সম্প্রতি দুই দেশের সীমান্ত ইস্যু, অভিবাসন, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে চীনের প্রভাব নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ভারত মনে করছে, বাংলাদেশের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক আরও গভীর এবং বাস্তবভিত্তিক নীতির ওপর নির্ভর করতে হবে, যেখানে কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, জনগণের স্বার্থও গুরুত্ব পাবে।
এই প্রেক্ষাপটে জয়সোয়ালের মন্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাঁর কথায়, “ভারত ও বাংলাদেশ বহুস্তরীয় ও বহুপর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় কাঠামোর মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। দুই দেশের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা, অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব ও নিরাপত্তা বিষয়ক স্বার্থ কেবল রাজনৈতিক প্রশাসনের উপর নির্ভর করে না, বরং পারস্পরিক আস্থা ও নীতিগত সদিচ্ছার ভিত্তিতে বিকশিত হয়।”
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থান থেকে স্পষ্ট—বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধর্মীয় উগ্রতা ও চীনের সক্রিয় ভূরাজনৈতিক তৎপরতা ঘিরে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তা সমাধানে নয়াদিল্লি সক্রিয়ভাবে কূটনৈতিক সংলাপ চায়। তবে সেই সংলাপ হতে হবে শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতাপূর্ণ পরিবেশে।
সূত্র: এএনআই
Leave a comment