পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের উত্তর ওয়াজিরিস্তানে আত্মঘাতী বোমা হামলায় দেশটির সেনাবাহিনীর ১৩ সদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২৯ জন, যাঁদের মধ্যে ১৯ জন বেসামরিক নাগরিক। সেনাবাহিনীর আহত সদস্যদের মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
শনিবার সকালে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সময় অনুযায়ী বেলা এগারোটার দিকে সেনাবাহিনীর একটি গাড়িবহর উত্তর ওয়াজিরিস্তানের একটি গ্রামীণ এলাকা দিয়ে অতিক্রম করছিল। ঠিক সে সময়ই বিস্ফোরকবোঝাই একটি গাড়ি নিয়ে আত্মঘাতী এক বোমারু বহরের একটি যানকে লক্ষ্য করে আঘাত হানে। তীব্র বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই বেশ কয়েকজন সেনা নিহত হন, আহত হন আরও অনেকে।
জেলা প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বিস্ফোরণটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে আশপাশের বাড়িঘরের জানালা, দরজা উড়ে যায়। দুটি ঘরের ছাদ ধসে পড়ে এবং এতে অন্তত ছয় শিশু আহত হয়। বিস্ফোরণের পরপরই নিরাপত্তা বাহিনী পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে এবং উদ্ধার অভিযান শুরু করে।
জেলা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, হামলাটি ছিল সুপরিকল্পিত এবং শক্তিশালী বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে। নিহত সেনা সদস্যদের লাশ হেলিকপ্টারে করে সামরিক ঘাঁটিতে নেওয়া হয়েছে এবং আহতদের স্থানীয় সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
পাকিস্তানি তালেবান হিসেবে পরিচিত তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-এর একটি উপদল, হাফিজ গুল বাহাদুর গোষ্ঠীর আত্মঘাতী শাখা এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। সংগঠনটির তরফ থেকে এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, তারা সেনাবাহিনীর “দমনমূলক” কার্যক্রমের প্রতিশোধ নিতেই এই হামলা চালিয়েছে।
উত্তর ওয়াজিরিস্তান অঞ্চলটি আফগানিস্তান সীমান্তঘেঁষা দুর্গম ও অস্থির এলাকা হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরেই এই অঞ্চলটি তালেবান ও বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যদিও ২০১৪ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী “জারব-এ-আজব” নামে বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালিয়ে বহু জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংসের দাবি করে, কিন্তু গত কয়েক বছরে এ অঞ্চলে আবারও সহিংসতা বাড়তে শুরু করেছে।
সরকারি ও বেসরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তান প্রদেশে জঙ্গি হামলার সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। শুধু ২০২৫ সালেই ১০০-র বেশি হামলায় কয়েকশ সেনা ও বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।
এদিকে, পাকিস্তান সরকার এসব সহিংসতার জন্য আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে দায়ী করে আসছে। ইসলামাবাদের অভিযোগ, আফগানিস্তানভিত্তিক তালেবান গোষ্ঠীগুলো পাকিস্তানে হামলা চালাতে সীমান্ত ব্যবহার করছে এবং কাবুল সরকার এ বিষয়ে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তবে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, তাদের ভূমি কোনো দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে না।
সাম্প্রতিক হামলার প্রেক্ষিতে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জরুরি বৈঠকে বসেছে। সেনাপ্রধান আসিম মুনির এক বিবৃতিতে বলেন, “এই হামলার কঠোর জবাব দেওয়া হবে। যারা দেশের নিরাপত্তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চায়, তাদের নির্মূল করা হবে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, জঙ্গি হামলার পুনরুত্থান পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য এক বড় হুমকি। অর্থনৈতিক দুরবস্থা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সীমান্ত অঞ্চলের অনিয়ন্ত্রিত নিরাপত্তা—এই তিনটির মিলিত প্রভাব দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানে আত্মঘাতী হামলা নতুন নয়। ২০০৭ সালের লাল মসজিদ অভিযান থেকে শুরু করে ২০১৪ সালের পেশোয়ার সেনা স্কুলে হামলা—সবগুলোতেই তালেবান সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে তারা আবারও সংঘবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা বাড়িয়ে দিয়েছে।
Leave a comment