তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে ছড়িয়ে পড়া তীব্র সরকারবিরোধী আন্দোলনের মুখে মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা দেশ ছেড়েছেন। ফরাসি সামরিক বাহিনীর একটি বিমানে করে তিনি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে পাড়ি জমান বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
সোমবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ‘জেনারেশন জেড’ বা জেন-জি তরুণদের নেতৃত্বে হওয়া আন্দোলনের জেরে কার্যত পতন ঘটেছে মাদাগাস্কারের সরকারের। দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।
বিরোধীদলীয় নেতা সিতেনি রান্দ্রিয়ানাসোলোনিয়াইকো জানান, প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনা রোববার রাতে দেশত্যাগ করেন। সেনাবাহিনীর কয়েকটি ইউনিট বিদ্রোহ করে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দেয়, যা সরকারের ওপর ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করে।
তিনি বলেন, “আমরা প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ে ফোন করে নিশ্চিত হয়েছি যে তিনি দেশ ছেড়েছেন। বর্তমানে তিনি কোথায় আছেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।”
এর আগে প্রেসিডেন্টের দফতর জানিয়েছিল, স্থানীয় সময় সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন রাজোয়েলিনা। তবে পরবর্তীতে সেই ভাষণ আর প্রচার করা হয়নি এবং প্রেসিডেন্ট কার্যালয় থেকেও কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
দেশটির সামরিক সূত্র রয়টার্সকে জানায়, রোববার বিকেলে একটি ফরাসি সামরিক কাসা বিমান মাদাগাস্কারের সেন্ট মেরি বিমানবন্দরে অবতরণ করে। মাত্র পাঁচ মিনিট পর আরেকটি উড়োজাহাজ এসে কিছু যাত্রীকে ওই বিমানে স্থানান্তর করে, যাদের মধ্যে ছিলেন প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনা । এরপরই বিমানটি প্যারিসের উদ্দেশে উড্ডয়ন করে।
ফরাসি কর্তৃপক্ষ এখনো এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি। তবে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, সাবেক ফরাসি উপনিবেশ মাদাগাস্কারের সঙ্গে ফ্রান্সের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণেই প্রেসিডেন্ট নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য প্যারিসকে বেছে নিয়েছেন।
২৫ সেপ্টেম্বর রাজধানী আন্তানানারিভো ও আশপাশের শহরগুলোতে পানি ও বিদ্যুৎ সংকটের প্রতিবাদে তরুণদের আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তা সরকারের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও মৌলিক সেবার সংকটের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলনে রূপ নেয়।
বিক্ষোভকারীরা “নতুন প্রজন্মের জন্য নতুন মাদাগাস্কার” শ্লোগানে দেশজুড়ে রাস্তায় নামে। আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, তরুণ পেশাজীবী এবং বেকার জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অংশগ্রহণ দেখা যায়।
একপর্যায়ে আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে সেনাবাহিনীর কিছু অংশ বিক্ষোভকারীদের পাশে দাঁড়ালে সরকার কার্যত নিয়ন্ত্রণ হারায়। রাজধানীর প্রধান সরকারি ভবনগুলো ঘিরে বিক্ষোভ চলতে থাকে, আর ঠিক সেই সময় প্রেসিডেন্টের দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ে।
বর্তমানে দেশটির নির্বাহী ক্ষমতা কার হাতে থাকবে তা নিয়ে কোনো স্পষ্ট ঘোষণা আসেনি। বিরোধীদলগুলো দাবি করছে, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষত জাতিসংঘ ও আফ্রিকান ইউনিয়ন, শান্তিপূর্ণ সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতি দেশটিতে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে। বিশ্লেষক হাজা রাকোটোন্দ্রাইনী বলেন, “মাদাগাস্কার দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্রের ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। যদি সেনা ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় না হয়, তাহলে দেশটি আরেকটি অভ্যুত্থানের দিকে এগোতে পারে।”
রাজোয়েলিনার দেশত্যাগে ফরাসি সামরিক বাহিনীর সম্পৃক্ততা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো ফ্রান্সকে অনুরোধ করেছে, তারা যেন এই ঘটনায় তাদের ভূমিকা স্পষ্ট করে এবং প্রেসিডেন্টকে সম্ভাব্য দুর্নীতি বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় থেকে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ না দেয়।
রাজোয়েলিনার দেশত্যাগের পর রাজধানীজুড়ে বিক্ষোভকারীরা আনন্দ মিছিল করে। অনেকেই একে ‘জনতার বিজয়’ হিসেবে উদযাপন করলেও, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা সতর্ক করেছেন যে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে এখন প্রয়োজন সুসংগঠিত রাজনৈতিক রূপান্তর।
এক তরুণ বিক্ষোভকারী বলেন, “আমরা শুধু একজন প্রেসিডেন্টকে সরাতে চাইনি, আমরা চাই একটি নতুন মাদাগাস্কার—যেখানে সবার জন্য ন্যায়বিচার, কাজ এবং সম্মান থাকবে।”
প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনার দেশত্যাগ মাদাগাস্কারের ইতিহাসে আরেকটি নাটকীয় মোড়। তবে তার প্রস্থান শুধু এক নেতার পতন নয়, বরং তরুণ প্রজন্মের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক শক্তির প্রতিফলনও বটে। এখন প্রশ্ন—এই আন্দোলন কি নতুন আশা জাগাবে, নাকি দেশটিকে আরও গভীর অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেবে? সময়ই তার উত্তর দেবে।
Leave a comment