
ঘর মানে কি শুধু চার দেয়ালের অবকাঠামো? নাকি তা এক ধরণের অনুভূতি—হৃদয়ের এক কোমলতম বাসস্থান? ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ চলচ্চিত্রে ছোট্ট সীতার মতোই গাজার শিশু কারেম সামরারও হয়তো একই প্রশ্ন। সীতা যেমন তাঁর নতুন বাড়ির খোঁজে ছুটেছিল দাদার হাত ধরে, গাজার শিশুরাও তেমনি ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে খুঁজছে সেই চেনা আশ্রয়, সেই হারিয়ে যাওয়া জানালার শিক, যার গায়ে হেলান দিয়ে একসময় তারা তাকাত আকাশের দিকে।
কারেম সামরা যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে থেকেও মনে রেখেছে তার স্কুলঘর, তার প্রিয় জানালা, ফুলের বাগান আর প্রজাপতিরা। মনে রেখেছে ক্রেয়নের বাক্স—যার সঙ্গে আঁকা হত স্বপ্নের ঘর। অথচ সেই ঘর আজ নেই, নেই সেই জানালা, সেই খেলাঘর। বোমার আঘাতে স্কুলভবন ধূলিসাৎ, কিন্তু কারেমের হৃদয়ে আঁকা ছবি এখনও উজ্জ্বল।
বাড়ির প্রতি এই টান শুধু কল্পনার নয়, বাস্তবতারও। আল–জাজিরা ও সিএনএনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার মানুষদের ফিরে আসার গল্প। ঘরে ফিরেও তাঁরা পাননি ঘর, শুধু পেয়েছেন ধ্বংসস্তূপ। কেউ খুঁজে পাননি পোশাক বদলানোর ঘর, কেউ খুঁজে পাননি দরজার চিহ্নও।
গাজার আবদুল ফাত্তাহর মতো অনেকেই তাই বলেন, “ফিরে এলাম, কিন্তু কিছুই নেই। যেন জন্মের সময়ের মতো নিঃস্ব আমি।” ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংস হওয়া বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ নিশ্চুপে তাকিয়ে থাকেন, কেউ হয়তো মাটিতে বসে শোনেন ভেতর থেকে ভেসে আসা সেই পুরোনো শুশ্রূষার সুর—যেখানে একদিন তাঁরা গড়েছিলেন জীবন, ভালোবাসা, পরিবার।
এই দৃশ্যের সঙ্গে আশ্চর্য রকমের মিল রয়েছে ‘সুবর্ণরেখা’র সেই কল্পনার নতুন বাড়ির। যেখানে ছিল ফুল, পাখি, নদী আর একটুকরো শান্তি। গাজার মানুষেরাও আজ তেমনি এক সুবর্ণরেখার পেছনে ছুটছেন—একটি ঘরের আশায়, যার অবস্থান হয়তো শুধুই হৃদয়ের গভীরে।
এ যেন এক যুদ্ধবিধ্বস্ত শিশুর চোখে চৌকো জানালার আলোর স্বপ্ন এঁকে দেওয়ার গল্প। আর প্রশ্ন থেকে যায়—ঘরের খোঁজ কি কেবল স্থানভিত্তিক? নাকি তা হৃদয়েরই একটা স্পন্দন, একটা আশ্রয়, যেখানে মানুষ ফিরে যায় নিজের ভেতরে, আবারও নতুন করে ঘর বাঁধার স্বপ্নে?
Leave a comment