গাজীপুরের চক্রবর্তী বাজারে রোদ ঝলমলে সকালের মধ্যে মনির শেখের ঠেলাগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে আসা দৃশ্য যেন এক অচেনা বাস্তবতার প্রতীক। এক যুগেরও বেশি সময় বেক্সিমকোর পোশাক কারখানায় কাজ করা এই শ্রমিকের হাতে আজ নেই সুই-সুতা, আছে শসা, বেগুন আর লাউয়ের ঝুড়ি। চাকরি হারানোর পর অসংখ্য কারখানার দরজায় কড়া নিলেও কাজ মেলেনি—অবশেষে পেট চালাতে বেছে নিতে হয়েছে সবজি বিক্রির পেশা।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর একে একে বন্ধ হয়ে যায় গাজীপুরের ১০৬টি শিল্পকারখানা। শিল্প পুলিশের হিসাবে, এতে ৭৩ হাজার শ্রমিক কাজ হারান। শুধু বেক্সিমকো গ্রুপের ১৩টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে, চাকরি হারিয়েছেন ২৮ হাজার ৫১৩ শ্রমিক। অনেকেই গ্রামে ফিরে গেছেন, কেউ চালাচ্ছেন অটোরিকশা, কেউ ফেরি করছেন, আবার কেউবা চায়ের দোকান খুলেছেন।
যশোরের জামাল হোসেনও তাঁদের একজন। প্রায় এক দশক বেক্সিমকোতে কাজ করার পর চাকরি হারিয়ে প্রথমে গ্রামে হালচাষে নেমেছিলেন, কিন্তু তাতেও মন বসেনি। স্ত্রী–সন্তানকে গ্রামে রেখে আবার গাজীপুরে ফিরে এসেছেন কাজের খোঁজে—তবু খালি হাতেই ফিরছেন প্রতিদিন। একই কলোনির আনিসুর রহমান একসময় কারখানার মেশিন চালাতেন, এখন ফেরি করে পণ্য বিক্রি করছেন।
কারখানা বন্ধের অভিঘাত পড়েছে পুরো এলাকাজুড়ে। আগে শ্রমিকদের আনাগোনায় মুখর থাকা বেক্সিমকো এলাকার রাস্তাঘাট আজ নির্জন। ‘বাসা খালি আছে’ সাইনবোর্ড ঝুলছে অসংখ্য বাড়িতে। মুদি দোকান, গয়নার দোকান, এমনকি হোটেল–রেস্তোরাঁও ক্রেতাশূন্য। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগের তুলনায় বিক্রি নেমে এসেছে পাঁচ ভাগের এক ভাগে।
শ্রমিকদের এই অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক জোট। সংগঠনের নেতারা বলছেন, নতুন কাজ না পাওয়ায় অনেকেই বাধ্য হয়ে পেশা বদলাচ্ছেন, তবে মনের মধ্যে রয়ে গেছে ছাঁটাই আতঙ্ক। শিল্প পুলিশ বলছে, শ্রমিক অসন্তোষ আপাতত নিয়ন্ত্রণে থাকলেও কিছু কারখানায় এখনও আর্থিক সংকট ও কার্যাদেশ বাতিলের কারণে অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে।
গাজীপুরের এই বাস্তবতা শুধু কয়েকজন শ্রমিকের গল্প নয়—এটি এক শিল্পনগরীর অর্থনৈতিক প্রাণশক্তি হারানোর কাহিনি, যেখানে নতুন জীবিকার খোঁজে শ্রমিকেরা প্রতিদিন লড়ছেন অজানা ভবিষ্যতের সঙ্গে।
Leave a comment