গাজায় এখন কেবল আগুনের লেলিহান শিখা, ধ্বংসস্তূপ আর আর্তনাদের প্রতিধ্বনি। প্রতিদিন হাজার হাজার বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত হচ্ছে শহর, ঝরছে নিরীহ প্রাণ। শিশুদের খেলার জায়গা পরিণত হয়েছে লাশের স্তূপে, হাসপাতালের বিছানাগুলো রক্তে ভিজে গেছে। মা তাঁর নিথর সন্তানের হাত ধরে আর্তনাদ করছেন, বাবা পুরো পরিবার হারিয়ে নির্বাক। অথচ বিশ্ব যেন সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করছে। আর মুসলিম বিশ্ব? তারা সম্পূর্ণ নীরব!
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলের অবিরাম বিমান হামলায় এখন পর্যন্ত ৪৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের প্রায় অর্ধেকই শিশু। আহত হয়েছেন আরও কয়েক লাখ। গাজা পরিণত হয়েছে এক ধ্বংসস্তূপে। খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা—কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা মানুষের আর্তনাদই এখন গাজার প্রতিদিনের বাস্তবতা।
এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সময়েও মুসলিম দেশগুলো কার্যত নিষ্ক্রিয়। তারা কি সত্যিই কিছু করতে পারছে না, নাকি স্বার্থের কারণে ইচ্ছাকৃতভাবে নীরব রয়েছে? মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক পরাশক্তি সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর—এরা কি শুধু উদ্বেগ প্রকাশ করে দায় এড়াবে? মুসলিম দেশগুলোর সামরিক শক্তি বিশাল, অথচ ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় তারা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
বেশ কিছু আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, কেউবা বাণিজ্যিক চুক্তি করেছে। ফলে তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারছে না। কারণ, তারা জানে, ইসরায়েলের বিপক্ষে অবস্থান নিলে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে, তাদের সরকার টলিয়ে দিতে পারে। তাই নিজেদের ক্ষমতা রক্ষার জন্য তারা ফিলিস্তিনের রক্তপাতকে উপেক্ষা করছে।
অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্ব বরাবরের মতো ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যেই ইসরায়েলকে অস্ত্র ও বোমা সরবরাহ করছে, জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পক্ষে যেকোনো পদক্ষেপ আটকে দিচ্ছে।
প্রশ্ন জাগে, ফিলিস্তিনিরা কি একাই লড়বে? প্রতিদিন শত শত নিরীহ মানুষের মৃত্যু দেখে বিশ্ব চুপ থাকতে পারে, কিন্তু মুসলিম দেশগুলো কীভাবে চুপ থাকে? ইসলামের শিক্ষা কি বলে? আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.) কি অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেননি?
গাজায় চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে হলে মুসলিম দেশগুলোকে একত্র হয়ে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু উদ্বেগ প্রকাশ বা বিবৃতি দিয়ে কিছু হবে না। কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
কিছু বাস্তবসম্মত করণীয় হতে পারে—
তেল নিষেধাজ্ঞা: আরব দেশগুলো যদি ইসরায়েলের মিত্রদের কাছে তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে বড় অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে তারা।
কটনৈতিক চাপ: মুসলিম দেশগুলো একত্র হয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে।
মানবিক সহায়তা: গাজার মানুষের জন্য জরুরি খাদ্য, পানি, ওষুধ ও চিকিৎসা সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
সামরিক সতর্কতা: মুসলিম দেশগুলো যদি ইসরায়েলকে সামরিকভাবে সতর্ক করে, তাহলে তারা এত সহজে ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালাতে পারবে না।
একদিন ইতিহাস প্রশ্ন করবে—যখন গাজা ধ্বংস হচ্ছিল, তখন মুসলিম বিশ্ব কী করছিল? যখন একটি শিশু ধ্বংসস্তূপের নিচে কাঁপতে কাঁপতে বলছিল, ‘মা, আমি কি বেঁচে আছি?’ তখন মুসলিম বিশ্ব নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল কেন?
আজ যদি গাজার জন্য কিছু না করা হয়, তবে একদিন এই নীরবতাই মুসলিম বিশ্বের পতনের কারণ হবে। এখনো সময় আছে—দাঁড়ান, প্রতিবাদ করুন, গাজার পাশে থাকুন। কারণ, গাজার ধ্বংস মানেই মানবতার পরাজয়।
Leave a comment