বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে “বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ” একটি গুরুত্বপূর্ণ দর্শন, যা দেশের জাতীয় পরিচয় ও রাষ্ট্রদর্শনের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই দর্শনের মূল স্থপতিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খন্দকার আবদুল হামিদ। তার রাজনৈতিক চেতনা ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। তবে অনেকেই জানেন না, এই জাতীয়তাবাদী ধারণার অন্যতম প্রবর্তক ছিলেন খন্দকার আবদুল হামিদ, যার নিরলস গবেষণা ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি শক্তিশালী ভিত্তি হয়ে ওঠে।
জাতীয়তাবাদী চিন্তার উত্থান
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দেশকে এগিয়ে নিতে একটি নতুন জাতীয় পরিচয় প্রয়োজন ছিল। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যখন দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়, তখন খন্দকার আবদুল হামিদ তার লেখনীর মাধ্যমে “বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ” ধারণার কথা উপস্থাপন করেন।
এই জাতীয়তাবাদ মূলত ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল বাংলাদেশির একটি অভিন্ন জাতীয় পরিচয়ের কথা বলে, যা ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। এটি ছিল পাকিস্তানপন্থী ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ও ভারতীয় জাতিগত জাতীয়তাবাদের বিপরীতে একটি স্বতন্ত্র চিন্তাধারা।
সাংবাদিকতা থেকে রাজনৈতিক দর্শনের বিকাশ
খন্দকার আবদুল হামিদ কেবল একজন রাজনীতিবিদই নন, তিনি একজন স্বনামধন্য সাংবাদিকও ছিলেন। দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক আজাদ, এবং দৈনিক দেশ পত্রিকায় সম্পাদকীয় কলামে তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। তার লেখনীতে উঠে আসে একটি স্বাধীন জাতি গঠনের প্রক্রিয়া, যেখানে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা রক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
তার কলাম “মঞ্চে-নেপথ্যে” এবং “স্পষ্টভাষী” পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা শুধু একটি ভৌগোলিক স্বাধীনতা নয়, এটি একটি স্বতন্ত্র জাতীয় চেতনার জন্ম দিয়েছে, যা আমাদের নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি হওয়া উচিত।”
জিয়াউর রহমান ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন নতুন রাজনৈতিক দর্শনের কথা ভাবছিলেন, তখন তার অন্যতম পরামর্শক ছিলেন খন্দকার আবদুল হামিদ। তার রাজনৈতিক ও সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা এবং গভীর বিশ্লেষণী ক্ষমতা জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কাঠামো গঠনে সহায়তা করে। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে বিএনপি গঠনের সময় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে দলের মূল আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়, যা পরবর্তীতে সংবিধানে যুক্ত হয়।
রাজনৈতিক সংগ্রাম ও উত্তরাধিকার
বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রচারের জন্য তিনি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হন। ১৯৭৯ সালে জামালপুর-৬ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিনি যুব উন্নয়ন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বে জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশের নীতি ও কূটনীতি গঠনের একটি নতুন ধারা সূচিত হয়।
চিরস্মরণীয় অবদান
১৯৮৩ সালে তার মৃত্যু হলেও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শ আজও দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখে চলেছে। তার চিন্তাধারা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও লেখনী এখনও জাতীয়তাবাদী চেতনার অন্যতম ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
খন্দকার আবদুল হামিদ কেবল একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক দূরদর্শী চিন্তাবিদ, যিনি তার কলম ও কর্মের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আজও, তার রেখে যাওয়া আদর্শ ও চিন্তা-চেতনা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অন্যতম ভিত্তি হয়ে রয়েছে।
Leave a comment