আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক সংবেদনশীল মুহূর্তের জন্ম দিয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক আলোচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি ডরোথি শিয়ার বক্তব্য। সভায় বক্তৃতাকালে মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাস ও দুর্ভোগ ছড়ানোর প্রসঙ্গে তিনি প্রথমে ‘ইসরায়েল সরকার’র নাম উল্লেখ করেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে থেমে গিয়ে সংশোধিতভাবে বলেন, “আমরা বলতে চাচ্ছি, ইরান সরকারই এই অঞ্চলে বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস ও দুর্ভোগ ছড়িয়েছে।” যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি অনুপস্থিত থাকায় শিয়া ওই সভায় মার্কিন প্রতিনিধিত্ব করছিলেন।
এই ঘটনা ঘটে এমন এক সময়ে, যখন মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। ১৩ জুন থেকে ইসরায়েল একের পর এক ইরানের পরমাণু স্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে, যার জবাবে ইরানও পাল্টা সামরিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এরই পটভূমিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ এই আলোচনায় মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
শিয়ার বক্তব্যের প্রথমাংশে ‘ইসরায়েল সরকার’ উল্লেখ করায় কিছু সময়ের জন্য কূটনৈতিক মহলে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। উপস্থিত কূটনীতিকদের অনেকে বিস্মিত হয়ে পড়েন। তবে শিয়া দ্রুত বাক্য পুনরায় পাঠ করেন এবং স্পষ্ট করে বলেন, তিনি ইরান সরকারকে লক্ষ্য করেই ওই মন্তব্য করতে চেয়েছেন।
তিনি বলেন, “গত সপ্তাহে জি-৭ নেতারাও উল্লেখ করেছেন, ইরান মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাসের মূল উৎস। তাদের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেই আমরা বলছি— ইরানই এই অঞ্চলের নিরাপত্তা হুমকির প্রধান উৎস।” তিনি আরও বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সাম্প্রতিক অভিযানে সরাসরি জড়িত না হলেও, আমরা ইসরায়েলের পাশে আছি এবং ইরানের পরমাণু উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধকে সমর্থন করি।”
ডরোথি শিয়া অভিযোগ করেন, “ইরানের হাতে ইতোমধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রয়োজনীয় উপাদান রয়েছে, যা আমাদের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য।” তিনি নিরাপত্তা পরিষদের উদ্দেশ্যে বলেন, “এই পরিষদের উচিত ইরান সরকারকে পরমাণু উচ্চাভিলাষ পরিহারের আহ্বান জানানো, যাতে আর কোনো ধ্বংসযজ্ঞ না ঘটে।”
মার্কিন এই মন্তব্য এমন সময়ে এল যখন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইরান ও ইসরায়েল দ্বন্দ্ব ঘিরে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে ইসরায়েলের একতরফা অভিযানে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ভেঙে দেওয়ার চেষ্টাকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ছে।
জাতিসংঘে ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, “এই ধরনের ভুল শুধুমাত্র কূটনৈতিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়ই দেয় না, বরং তা আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপের ইঙ্গিতও দেয়।” তিনি আরও বলেন, “ইসরায়েল বছরের পর বছর ধরে ফিলিস্তিন ও অন্যান্য প্রতিবেশী অঞ্চলে সন্ত্রাস ও আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে, অথচ সেটিকে পাশ কাটিয়ে শুধুমাত্র ইরানকে দোষারোপ করার কূটনীতি বৈষম্যমূলক এবং অগ্রহণযোগ্য।”
অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আরেকজন প্রতিনিধি পরে বলেন, “বক্তব্যে অনিচ্ছাকৃত ভুল ছিল, কিন্তু আমাদের অবস্থান পরিষ্কার— আমরা ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরোধী এবং এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্য জরুরি।”
জাতিসংঘের এই বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন প্রতিনিধি এবং রাশিয়া ও চীনের কূটনীতিকরাও বক্তব্য দেন। তারা মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি নিশ্চিত করতে উভয় পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানান এবং জাতিসংঘ সনদের আলোকে দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
বিশ্লেষকদের মতে, ডরোথি শিয়ার এই মন্তব্য ভবিষ্যতে আমেরিকান কূটনীতিতে ব্যাখ্যার প্রয়োজন হতে পারে। বিশেষ করে, মার্কিন প্রশাসনের ‘ইসরায়েলঘেঁষা’ নীতির মধ্যে এমন একটি বক্তব্য কতটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল না, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হতে পারে।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারীরা মনে করছেন, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সামরিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে বড় পরিসরের সংঘাতে গড়ানোর আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। আর জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের দায়িত্ব এখন সংঘাত নিরসনের কূটনৈতিক পথ সুগম করা, যাতে করে মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা আর গাঢ় না হয়।
সূত্র: আল জাজিরা
Leave a comment