পশ্চিম এশিয়ায় চলমান সংঘাত, বিশেষ করে গাজা ও ইরানে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের বিষয়ে ভারতের সরকারি অবস্থানকে ‘নীরবতা ও নৈতিক বিচ্যুতি’ বলে আখ্যা দিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কঠোর সমালোচনা করেছেন কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী। শনিবার (২১ জুন) ভারতের শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দু-তে প্রকাশিত তাঁর এক নিবন্ধে এসব মন্তব্য করেন তিনি। নিবন্ধটির শিরোনাম ছিল, “Even Now, India Can Find Its Voice”।
সোনিয়া গান্ধী তাঁর লেখায় গাজার মানবিক বিপর্যয় এবং ইরানে ইসরায়েলি আক্রমণ প্রসঙ্গে ভারতের সরকারিভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেওয়াকে এক ধরনের ‘নৈতিক আত্মবিসর্জন’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘ভারত শুধু কণ্ঠরোধ করেনি, বরং দীর্ঘদিনের নৈতিক অবস্থান, মূল্যবোধ ও কূটনৈতিক ঐতিহ্য থেকেও সরে এসেছে।’
সোনিয়া গান্ধী লেখেন, ভারত বহু দশক ধরে ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং দুই রাষ্ট্রভিত্তিক শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষপাতী থেকেছে। অথচ বর্তমান সরকার সে অবস্থান থেকেও সরে এসেছে। তাঁর ভাষায়, “মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার শুধু নীরব থাকেনি, বরং ভারত যে মূল্যবোধে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বিশ্বাস করেছে, সেগুলোকেও বিসর্জন দিয়েছে।”
গাজার মানবিক সংকট নিয়ে তিনি বলেন, “গাজায় ৫৫ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। সম্পূর্ণ পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হাসপাতাল ধ্বংস হয়েছে, এলাকার পর এলাকা ধূলিসাৎ হয়েছে, এবং পুরো অঞ্চল এখন দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে।” এ ধরনের ঘটনায় ভারতের নীরবতা আন্তর্জাতিক পরিসরে ভারতের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সোনিয়া তাঁর নিবন্ধে মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পেরও সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘যিনি একসময় যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধনীতির সমালোচক ছিলেন, সেই ট্রাম্পই এখন এমন এক ধ্বংসাত্মক কৌশল গ্রহণ করেছেন, যা তাঁর পূর্বসূরিদের পথেই চলেছে।’ একই সঙ্গে তিনি ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসনের “আগ্রাসী ও একতরফা” ভূমিকারও সমালোচনা করেন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে সোনিয়া গান্ধীর অভিযোগ, তাঁর নেতৃত্বে ইসরায়েল এক উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাবের উসকানি দিচ্ছে, যা সংলাপের সুযোগকে ধ্বংস করছে। তিনি বলেন, ‘নেতানিয়াহুর অতীতই প্রমাণ করে, তিনি সংঘাতের পথেই বিশ্বাসী। শান্তি বা আলোচনার কোনো পরিবেশ তিনি তৈরি করেননি।’
সোনিয়া তাঁর নিবন্ধে ভারত-ইরান সম্পর্কের ঐতিহাসিক দিকটিও তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, “১৯৯৪ সালে জাতিসংঘে কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় ইরানের বিরোধিতার কারণে। ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেও ইরান পরোক্ষভাবে ভারতের পাশে ছিল।” তাঁর মতে, এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতি সম্মান জানিয়ে হলেও ভারতের উচিত ছিল ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান নিয়ে একটি দায়িত্বশীল ও মানবিক অবস্থান গ্রহণ করা।
নিবন্ধের শেষে সোনিয়া গান্ধী ভারত সরকারকে আহ্বান জানান, যেন তারা আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের অবস্থান পরিস্কার করে এবং পশ্চিম এশিয়ায় উত্তেজনা নিরসনে কার্যকর কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তিনি বলেন, “এখনো খুব দেরি হয়নি। ভারত এখনো তার নৈতিক অবস্থানে ফিরে যেতে পারে। শান্তি ও সংলাপের পরিবেশ তৈরিতে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারে।”
এ নিয়ে ইতিমধ্যে কংগ্রেসের অন্য নেতারাও বিভিন্ন সময়ে সরকারের সমালোচনা করেছেন। লোকসভায় বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধী, দলের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে, কেরালার ওয়েনাড থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রসহ অনেকেই গাজা ও ইরান পরিস্থিতিতে ভারতের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সোনিয়া গান্ধীর এই নিবন্ধকে তাই কংগ্রেসের অবস্থানের একটি আনুষ্ঠানিক ও নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সূত্র: দ্য হিন্দু
Leave a comment