মধ্যপ্রাচ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে ইরানের চালানো একাধিক ড্রোন হামলা ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে, ইরান থেকে ছোড়া দুটি ড্রোন শুক্রবার দিবাগত রাতে ইসরায়েলের আকাশসীমা অতিক্রম করে দেশটির উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে পৃথকভাবে আঘাত হানে। এই হামলাকে ‘বিরল ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করেছে ইসরায়েলি সামরিক কর্তৃপক্ষ, কারণ সাধারণত তারা দাবি করে, অধিকাংশ ইরানি ড্রোনই লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানোর আগেই ভূপাতিত করা হয়।
শনিবার (২১ জুন) মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের বরাতে জানা যায়, ইরান থেকে ছোড়া একটি ড্রোন উত্তর ইসরায়েলের জর্ডান সীমান্তঘেঁষা বেইত শেইন শহরে আঘাত হানে। সেখানে একটি দুইতলা আবাসিক ভবন ধসে পড়ে। ভবনটির পাশের রাস্তায় বড় একটি গর্ত সৃষ্টি হয় এবং আশপাশের বাড়িগুলোর জানালা-দরজা উড়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা বিস্ফোরণের পরপরই আতঙ্কিত হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছুটে যান।
ইসরায়েলের জরুরি সেবা সংস্থা মাগেন ডেভিড আদম (এমডিএ) জানায়, তারা ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের ধ্বংসস্তূপে তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে আশপাশের একাধিক ভবনেও ফাটল দেখা দিয়েছে।
একই ধরনের আরও একটি ড্রোন দক্ষিণ ইসরায়েলের একটি খোলা এলাকায় আঘাত হানে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র জানান, এই হামলায় কোনো হতাহত বা বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে তারা স্বীকার করেছেন, দুটি ড্রোনই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল, যা ইসরায়েলের জন্য একটি উদ্বেগজনক বার্তা।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) বিবৃতিতে বলা হয়, ইরান এই হামলার মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছে যে তারা শুধু ক্ষেপণাস্ত্র নয়, উন্নত ড্রোন প্রযুক্তিতেও সক্ষমতা অর্জন করেছে। আইডিএফ দাবি করেছে, ইরানের ছোড়া ছয়টি ড্রোনের মধ্যে বাকি চারটি আরাভা মরুভূমি, নেগেভ এবং গোলান মালভূমি এলাকায় পৌঁছানোর আগেই প্রতিহত করা হয়েছে।
একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তা বলেন, “গত সপ্তাহে ইরানে আমাদের অভিযানের পর ইরান আকাশপথে আক্রমণের ঘনত্ব বাড়িয়েছে। তারা এক সপ্তাহে প্রায় হাজার খানেক ড্রোন ছুড়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করি, যার অধিকাংশই আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “কিন্তু সাম্প্রতিক এই দুটি ড্রোনের সফল অনুপ্রবেশ আমাদের নিরাপত্তা কাঠামোর কিছু দুর্বলতা স্পষ্ট করেছে। এখন সেগুলো নিরসনে কাজ চলছে।”
ইসরায়েলি বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ইরানের এই কৌশলগত আঘাত সামরিক দিক থেকে বড় ধ্বংস না ঘটালেও তা মনস্তাত্ত্বিক এবং প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে ইসরায়েলের জন্য একটি বার্তা। বিশেষত বেইত শেইনের মতো অভ্যন্তরীণ শহরে হামলা ইসরায়েলি নাগরিকদের মনে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে।
ইরান এই হামলা প্রসঙ্গে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি দেয়নি, তবে দেশটির রেভল্যুশনারি গার্ড (আইআরজিসি) ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমগুলো হামলার ফুটেজ প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এড়িয়ে ড্রোন দুটি লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছেছে।
এদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে বলেন, “আমাদের শত্রুরা মনে করছে তারা আমাদের আঘাত করতে পারবে, কিন্তু তারা জানে না আমাদের প্রতিক্রিয়া কতটা তীব্র হতে পারে। আমরা ইরানের এই ধরণের আগ্রাসনের জবাব যথাযথ সময় ও পদ্ধতিতে দেব।”
এ হামলার ঠিক আগেই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সাম্প্রতিক সংঘর্ষ নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয়। ইরান জাতিসংঘে অভিযোগ তোলে যে ইসরায়েল তাদের ভূখণ্ডে আকাশসীমা লঙ্ঘন করে একাধিকবার হামলা চালিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। একইসঙ্গে তারা আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-এর প্রধানের পক্ষপাতমূলক অবস্থানের বিরুদ্ধেও অভিযোগ তোলে।
বিশ্লেষকদের মতে, চলমান সংঘাতে ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহারে একধরনের প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ইরান ও ইসরায়েল উভয়েই নিজেদের আক্রমণাত্মক সক্ষমতা বাড়াতে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং রাশিয়া ও চীনসহ একাধিক প্রভাবশালী দেশ এই পরিস্থিতি নিরসনে সংলাপ ও কূটনৈতিক আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে। তবে মাঠে বাস্তবতা ভিন্ন চিত্রই দেখাচ্ছে, যেখানে দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে পাল্টাপাল্টি সামরিক পদক্ষেপ নিচ্ছে।
তেল আবিব ও তেহরান উভয় শহরেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। সম্ভাব্য আরও হামলার আশঙ্কায় জনগণকে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে। তবে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে এবং যুদ্ধাবস্থার অনিশ্চয়তা তাদের দৈনন্দিন জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
সূত্র: সিএনএন
Leave a comment