২০২২ সালের ১৯ মে, লন্ডনের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কালজয়ী ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানের রচয়িতা, প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ আবদুল গাফফার চৌধুরী। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অঙ্গনে নেমে আসে গভীর শোকের ছায়া।
১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মেঘনা নদীঘেঁষা উলানিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন গাফফার চৌধুরী। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি যুক্ত ছিলেন ভাষা আন্দোলন, রাজনীতি ও সাংবাদিকতায়। কিন্তু ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন তিনি তাঁর অনবদ্য গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ রচনার মাধ্যমে। ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও বেদনার প্রতিফলন ঘটানো এই গান ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির পরপরই রচিত হয়। পরবর্তীতে শিল্পী আব্দুল লতিফের সুর ও পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের সঙ্গীতে এটি হয়ে ওঠে বাঙালির চেতনার প্রতীক।
গাফফার চৌধুরী ছিলেন একাধারে লেখক, কলামিস্ট, গবেষক এবং দেশের সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার অন্যতম বিশ্লেষক। সাংবাদিকতা পেশায় তাঁর ভূমিকা ছিল অসামান্য। দেশের বহু পত্রিকায় তিনি কলাম লিখেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ‘চন্দ্রাবতী কথা’, ‘নয়নভূষণ’, ‘লন্ডনের চিঠি’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় কলাম। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭৪ সালে তিনি স্থায়ীভাবে যুক্তরাজ্যে চলে যান এবং সেখান থেকেই আজীবন লেখালেখি, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সক্রিয় ছিলেন। প্রবাসে থেকেও তিনি কখনও দেশ ও ভাষার মাটিকে ভুলে যাননি। তাঁর লেখা ও মতামত বরাবরই ছিল প্রগতিশীলতা, গণতন্ত্র এবং ইতিহাস-চেতনার পক্ষে।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য তাঁকে বহুবার সম্মানিত করা হয়। একুশে পদক, বঙ্গবন্ধু পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ দেশ-বিদেশে নানা স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষ গভীর শোক প্রকাশ করেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যু এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করেছে, যা সহজে পূরণ হবার নয়। তিনি রেখে গেছেন তাঁর লেখা, তাঁর আদর্শ ও একটি গানের অমর বাণী—যা যুগের পর যুগ বাঙালিকে স্মরণ করিয়ে দেবে ভাষার জন্য আত্মত্যাগ আর চেতনার সৌন্দর্য।
Leave a comment