মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় যুক্ত হলো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আইনজীবী সোমা সাঈদের মাধ্যমে। পবিত্র কুরআনে হাত রেখে শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে তিনি নিউইয়র্ক স্টেট সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন—যা একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিকের জন্য প্রথম এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বহুসাংস্কৃতিক বিচারাঙ্গনে একটি বিরল ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
গত সোমবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্ক সিটির কুইন্স সিভিল কোর্ট হাউজে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সোমা সাঈদ বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। অনুষ্ঠানে উচ্চপদস্থ বিচারপতি, সরকারি কর্মকর্তা, কূটনৈতিক প্রতিনিধি, আইনজীবী এবং বিভিন্ন কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। শপথ গ্রহণের সময় পবিত্র কুরআন বেছে নেওয়াকে তিনি নিজের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও পরিচয়ের প্রতি শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আইন ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে এই শপথ শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত লক্ষাধিক প্রবাসী বাংলাদেশির জন্যও এক অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে। নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে এই খবরে ব্যাপক আনন্দ-উচ্ছ্বাস ও গর্বের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। কোথাও কোথাও মিষ্টি বিতরণ ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে এই ঐতিহাসিক সাফল্য উদযাপন করা হয়।
সোমা সাঈদ ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে জনগণের ভোটে নিউইয়র্ক স্টেট সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নির্বাচিত হন। যুক্তরাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থায় স্টেট ও স্থানীয় পর্যায়ের অনেক বিচারক ও বিচারপতি দলীয় কিংবা সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন—এটি বিশ্বের বহু দেশের বিচার ব্যবস্থার তুলনায় ব্যতিক্রমী। সেই প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী হিসেবে সোমা সাঈদের জয় বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
আইন অঙ্গনে সোমা সাঈদ নতুন মুখ নন। এর আগে ২০২১ সালে তিনি কুইন্স ডিস্ট্রিক্ট জাজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় তিনি ন্যায়নিষ্ঠা, পেশাদারিত্ব ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে আইনজীবী সমাজ ও সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করেন। তার বিচারিক কর্মকাণ্ডে আইনের শাসন ও ন্যায্যতার প্রতিফলন ঘটেছে—এমন মন্তব্য করেছেন সহকর্মী ও আইন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই নারী বিচারপতির উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থায় বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তির একটি শক্ত বার্তা বহন করে। বিভিন্ন ধর্ম, জাতিগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির মানুষের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা মার্কিন সমাজে ন্যায়বিচারের সর্বোচ্চ স্তরে এমন প্রতিনিধিত্ব বহুসাংস্কৃতিক গণতন্ত্রকে আরও দৃঢ় করে।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত কমিউনিটি নেতারা বলেন, সোমা সাঈদের এই অর্জন নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশি-আমেরিকান তরুণদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত। বিশেষ করে নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তরুণদের জন্য এটি প্রমাণ করে—যোগ্যতা, পরিশ্রম ও সততার মাধ্যমে যে কোনো উচ্চতায় পৌঁছানো সম্ভব।
নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে সোমা সাঈদ বলেন, এই দায়িত্ব তার কাছে শুধু একটি পদ নয়, বরং একটি আস্থা ও দায়বদ্ধতা। তিনি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে, আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে এবং সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
বিশ্লেষকদের মতে, পবিত্র কুরআনে হাত রেখে তার শপথ গ্রহণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত বিশ্বাসের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক শ্রদ্ধারও প্রতিফলন। এটি প্রমাণ করে যে, বিশ্বাস ও পেশাগত দায়িত্ব পরস্পরবিরোধী নয়; বরং সঠিক ভারসাম্যের মাধ্যমে উভয়ই সমুন্নত রাখা সম্ভব।
Leave a comment