Home আন্তর্জাতিক রাখাইনে সংখ্যালঘুদের ওপর আরাকান আর্মির ভয়াবহ দমন-পীড়ন
আন্তর্জাতিক

রাখাইনে সংখ্যালঘুদের ওপর আরাকান আর্মির ভয়াবহ দমন-পীড়ন

Share
Share

মিয়ানমারের উত্তর রাখাইনে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ওপর আরাকান আর্মির (এএ) দমন-পীড়ন দ্রুতই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর জোরপূর্বক সেনা ভর্তির চাপ, নির্যাতন, ঘরবাড়িতে হামলা ও সম্পদ লুটপাট এখন প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে। রবিবার রাতে ‘রোহিঙ্গা: সাইলেন্ট ভিকটিম অব ইনজাস্টিস’ নামে একটি পেজে প্রকাশিত পোস্টে এসব তথ্য উঠে আসে। স্থানীয় সূত্রেও একই অভিযোগ পাওয়া গেছে।

স্থানীয়দের মতে, আরাকান আর্মির লক্ষ্য এখন কেবল রোহিঙ্গা নয়—বরং রাখাইনের প্রায় সব সংখ্যালঘুই তাদের ‘টার্গেট’ হয়ে উঠছেন। বিশেষ করে চাকমা ও অন্যান্য ছোট জাতিগোষ্ঠীর ওপর চাপ বাড়ানো হয়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। তাদের প্রতি আচরণ যে কেবল সামরিক নিয়োগের সীমায় আটকে নেই, তা সাম্প্রতিক সহিংসতার ধরনই জানান দিচ্ছে ।

গত কয়েক সপ্তাহে নতুন করে অন্তত ৪০০-এর বেশি চাকমা পরিবারের মোট ১ হাজার ২৭২ জন ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে সীমান্তে এসে আটকা পড়েছে। তারা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্ট নো ম্যানস ল্যান্ড এবং কক্সবাজারের ঘুমধুম এলাকার কাছে অবস্থান করছে । এসব মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আরাকান আর্মি তাদের জোরপূর্বক সেনা ভর্তির জন্য চাপ দিচ্ছে এবং চাপ মানতে অস্বীকার করলেই শুরু হচ্ছে টর্চার, ভয়ভীতি প্রদর্শন, জুলুম ও সম্পদ লুটপাট।

স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের মতে, আরাকান আর্মি একই কৌশল অবলম্বন করছে যেটি তারা পূর্বে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল—নিয়মিত হুমকি, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, আতঙ্ক তৈরি, এবং শেষ পর্যন্ত জোরপূর্বক তাদের দলে ভিড়ানো। চাকমা সম্প্রদায়ের অভিযোগও একই: আরাকান আর্মির দলে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানালেই তাদের ওপর নেমে আসছে চরম নির্যাতন।

স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, এরা যেসব এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে, সেখানে সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর চলাচল, শ্রম, এমনকি দৈনন্দিন জীবনযাপনও তাদের নজরদারির বাইরে নয়। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারগুলোকে বাধ্যতামূলক শ্রমে লাগানো হচ্ছে। পুরুষ সদস্যদের কৃষিকাজ, রাস্তা নির্মাণ এবং সামরিক ঘাঁটির চারপাশে শ্রম দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। যারা এতে সম্মত নয়, তাদেরকে তুলে নিয়ে যাওয়া বা শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগও আছে।

পালিয়ে আসা পরিবারগুলোর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। সীমান্তের জিরো পয়েন্টে থাকা এসব মানুষ নিরাপদ আশ্রয়, পর্যাপ্ত খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি বা চিকিৎসা সুবিধা—কোনো কিছুই পাচ্ছেন না। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থানের কারণে আন্তর্জাতিক সহায়তাও ঠিকভাবে পৌঁছাতে পারছে না।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এসব পরিবারের জীবনযাত্রা এখন সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনে নেই কোনো নিরাপদ আশ্রয়স্থল, নেই ফেরার পথ। কারণ, রাখাইনে ফিরে গেলে আবারও একই সহিংসতার মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে রাখাইনে চলমান এই পরিস্থিতি কোনো রাজনৈতিক প্রতিরোধ আন্দোলন বা সামরিক ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নয়। বরং এটি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত আরেক দফা জাতিগত নিপীড়ন। তারা সতর্ক করে বলছেন, আন্তর্জাতিক মহল যদি সময়মতো হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে রোহিঙ্গাদের মতো আরও বহু জাতিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।

মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাখাইনে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতায় দ্রুত আন্তর্জাতিক নজরদারি, কূটনৈতিক চাপ ও মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। পরিস্থিতি উপেক্ষা করা হলে তা আরও বড় মানবিক বিপর্যয়ের রূপ নিতে পারে। বিশেষত সীমান্ত অঞ্চলে যারা আটকা পড়ে আছে—তারা যেকোনো সময় খাদ্য ও চিকিৎসা সংকটে জীবনহানির মুখে পড়তে পারে।

রাখাইনে পরিস্থিতি দিনদিন সংকটময় হয়ে উঠছে। সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ওপর আরাকান আর্মির সহিংসতার পরিসর বৃদ্ধির ফলে নতুন করে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। পালিয়ে আসা হাজারো মানুষের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে এই সংকট আরও গভীর, জটিল এবং ভয়াবহ রূপ নিতে পারে—যার প্রভাব সীমান্ত পেরিয়ে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপরও পড়বে।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don't Miss

পাকিস্তানে পুলিশের গাড়িতে আইইডি বিস্ফোরণ, নিহত ৩

পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় খায়বার পাখতুনখোয়া প্রদেশে পুলিশের গাড়িকে লক্ষ্য করে শক্তিশালী আইইডি বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। বুধবার (৩ ডিসেম্বর) দেরা ইসমাইল খান জেলার পানিয়ালা এলাকায়...

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালকে প্রত্যর্পণ করবে ভারত : প্রেস সচিব

জুলাই মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ভারত, বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ করবে বলে দাবি করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি...

Related Articles

লন্ডন যাচ্ছেন না খালেদা জিয়া

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য আপাতত লন্ডনে...

সীমান্তে বিজিবির বিশেষ অভিযানে ২ কোটি ৭৩ লাখ টাকার ভারতীয় পণ্য উদ্ধার

ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লা জেলার সীমান্ত এলাকায় টানা এক সপ্তাহের বিশেষ অভিযানে প্রায়...

রাজনীতিতে পূর্ণসময় দিতে চান সাকিব

বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সফল তারকা সাকিব আল হাসান স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন—ক্রিকেট...

মুর্শিদাবাদে ‘বাবরি মসজিদের’ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকে ঘিরে কলকাতায় পাল্টা কর্মসূচি 

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে নবনির্মিত ‘বাবরি মসজিদ’-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকে কেন্দ্র করে রাজ্যজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা...