বিশ্বজুড়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো দিবস পালনের প্রচলন রয়েছে। তবে এর মাঝে এমনও কিছু দিবস আছে, যা বহু মানুষের দৃষ্টির বাইরে থেকে যায়—তেমনি একটি দিন হলো ‘আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস’। আজ ১৯ নভেম্বর, বিশ্বব্যাপী পুরুষদের ইতিবাচক অবদান, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ এই বিশেষ দিনটি পালিত হচ্ছে।
যদিও নারী দিবস, শিশু দিবস বা মানবাধিকার দিবস তুলনামূলক বেশি আলোচিত, তবুও আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। পরিবার, সমাজ এবং কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের অবদানকে সম্মান জানানো ছাড়াও পুরুষ ও বালকদের স্বাস্থ্য, মানসিক সুস্থতা, লিঙ্গসমতা এবং দায়িত্ববোধকে নতুন করে উপলব্ধি করানোর দিন এটি।
দিবসটির প্রধান লক্ষ্য হলো—পুরুষদের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা, তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো এবং gender balance বা লিঙ্গ-নিরপেক্ষ মূল্যবোধকে উৎসাহিত করা। সমাজের আলোচনায় পুরুষদের নীরব অভিজ্ঞতা, চাপ ও দুর্বলতাগুলো প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। নিজেদের ‘পুরুষত্ব’ প্রমাণে সামাজিক চাপের কারণে তারা অনেক অনুভূতি আড়াল করে রাখেন, যা মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার ওপর প্রভাব ফেলে।
আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস তাই এমন একটি প্ল্যাটফর্ম—যেখানে বলা হয়, পুরুষরাও অনুভব করেন, কষ্ট পান, ভেঙে পড়েন, আবার উঠে দাঁড়ান। তাদের সংগ্রাম ও অবদানও সমানভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে। আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসের যাত্রা শুরু ট্রিনিডাড ও টোবাগো থেকে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল—লিঙ্গ নিয়ে আলোচনায় ভারসাম্য আনা এবং পুরুষদের অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা নিয়েও বৈশ্বিক পরিসরে কথা বলা।
১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অধ্যাপক টমাস ওস্টার প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস পালনের ধারণা সামনে আনেন। তখন এটি ফেব্রুয়ারিতে পালিত হতো। তবে ১৯৯৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসবিদ ড. জেরোম তিলক সিংয়ের নেতৃত্বে ১৯ নভেম্বর দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব পুরুষ দিবস হিসেবে নির্ধারিত হয়। ওই বছরই ট্রিনিডাড ও টোবাগোতে প্রথমবারের মতো দিবসটি পালিত হয় এবং পরে তা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
পুরুষদের ওপর থাকা সামাজিক প্রত্যাশা তাদের নীরব করে রাখে।
সমাজ বলে—
“পুরুষরা কাঁদে না”,
“দুর্বল হওয়া চলবে না”,
“সব দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে।”
এই ধারণাগুলো পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বড় প্রভাব ফেলে। সংসার চালানো, পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া, কর্মক্ষেত্রের চাপ সামলানো—সব মিলিয়ে একজন পুরুষ প্রতিদিনই বহু ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু তার অনুভূতি, তার সমস্যা, তার দুর্বলতার কথা খুব কমই শোনে।
আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস সেই নীরবতার ভেতর আলো ফেলতে চায়। পুরুষদের শক্তির পাশাপাশি তাদের মানবিক দিকও যে গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে—এ দিনটি সেই কথাটিই নতুন করে মনে করিয়ে দেয়।বর্তমানে বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশে দিবসটি পালিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীন, ভারত, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, নরওয়ে, ডেনমার্কসহ আরও অনেক দেশ।
বিভিন্ন দেশে এ দিনটিকে সামনে রেখে আয়োজন করা হয় স্বাস্থ্যসচেতনতা কর্মসূচি, আলোচনা সভা, সম্মাননা অনুষ্ঠান, ওয়ার্কশপ ও সহিংসতা প্রতিরোধ ক্যাম্পেইন।উন্নত বিশ্বে পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধ নিয়ে বিশেষ সচেতনতামূলক কার্যক্রমও বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের বহু দেশে পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। তাই তাদের মানসিক চাপ, ডিপ্রেশন ও একাকিত্ব দূর করার প্রচেষ্টাও এ দিবসকে ঘিরে আরও জোরদার হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস নারী অধিকার বা নারী দিবসের বিকল্প নয়—বরং লিঙ্গসমতাকে আরও ভারসাম্যপূর্ণ করে তোলার একটি দৃষ্টান্ত। নারীরা যেমন সমাজে বৈষম্যের শিকার হন, তেমনই পুরুষরাও কিছু বিশেষ সামাজিক চাপের মুখে পড়েন। এ দিবসের লক্ষ্য হলো—উভয় পক্ষের সমস্যাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা।
Leave a comment