বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে আজ ছিল একটি স্মরণীয় দিন । দীর্ঘদিন ধরে দেশের ক্রিকেটকে ধারাবাহিকভাবে সামনে এগিয়ে নেওয়া, সংকটমুহূর্তে দলের পাশে দাঁড়ানো এবং অসংখ্য সাফল্যের সাক্ষী হওয়া মুশফিকুর রহিম স্পর্শ করলেন আরেকটি অনন্য মাইলফলক—টেস্ট ক্রিকেটে শততম ম্যাচ। এই অর্জনের মাধ্যমে তিনি এমন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করলেন, যেখানে আগে কোনো বাংলাদেশি ক্রিকেটারের পদচিহ্ন ছিল না।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ শুরুর মুহূর্তেই ইতিহাসের পাতায় নতুন করে লেখা হলো মুশফিকের নাম। দীর্ঘ ১৯ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার পেরিয়ে যে দৃঢ়তা, পরিশ্রম ও অনমনীয় মানসিকতা নিয়ে তিনি নিজেকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন, তারই স্বীকৃতি এ শততম টেস্ট। কেবল ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্যও এটি এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
খেলা শুরুর আগে থেকেই পুরো মিরপুর স্টেডিয়াম ছিল এক বিশেষ আবহে মোড়ানো। টসের পরপরই মুশফিকুর রহিমকে ঘিরে আয়োজিত হয় সম্মান প্রদর্শনের আনুষ্ঠানিকতা, যেখানে উপস্থিত ছিলেন বর্তমান দলের সদস্যরা, সাবেক ক্রিকেটার, বিসিবি কর্মকর্তাসহ তার পরিবারের সদস্যরা। সকাল ৯টা ১৬ মিনিটে সতীর্থদের সঙ্গে মাঠে প্রবেশ করেন মুশফিক। মাঠে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সতীর্থরা সারিবদ্ধ হয়ে তাকে শুভেচ্ছা জানান। একটি সাধারণ মুহূর্তও আবেগে ভরে ওঠে।
মাত্র এক মিনিট পরই শুরু হয় ঐতিহাসিক সংযোগের আরেক অধ্যায়। দুই দশক আগে লর্ডসে মুশফিককে প্রথম টেস্ট ক্যাপ পরিয়ে দিয়েছিলেন হাবিবুল বাশার সুমন। সেই বাশারই এবার তার হাতে তুলে দেন বিশেষ ‘১০০তম টেস্ট’ ক্যাপ। যেন অতীত আর বর্তমান একই ফ্রেমে এসে মিলিত হলো—একটি সাফল্যের চিরস্থায়ী প্রতীক হিসেবে।
সংক্ষিপ্ত পর্বের পর মুশফিকের হাতে আরেকটি বিশেষ ক্যাপ তুলে দেন দেশের প্রথম টেস্ট ক্রিকেটার আকরাম খান। দেশের ক্রিকেটের সূচনালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত যাদের হাত ধরে এগিয়েছে বাংলাদেশ, সেই সব প্রজন্ম যেন এক বন্ধনে যুক্ত হলো মুশফিকের এই সাফল্যের মাধ্যমে।
এরপর বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল এবং ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান নাজমূল আবেদীন স্মারক উপহার দেন, যা দিনের উদযাপনকে আরও বর্ণময় করে তোলে। এই সব আয়োজনেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে—মুশফিক শুধুই একজন ক্রিকেটার নন, তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে এক স্থায়ী প্রতীক।
মুশফিকের প্রথম ও শততম টেস্ট—এই দুই ম্যাচের অধিনায়ক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হাবিবুল বাশার ও নাজমুল হোসেন শান্ত। তারা দু’জনই তাকে সতীর্থদের স্বাক্ষর করা স্মারক জার্সি উপহার দেন। সতীর্থদের ভালোবাসা, সম্মান আর শ্রদ্ধা যেন এই জার্সির মধ্যেই প্রতীকীভাবে ফুটে ওঠে।
সকাল ৯টা ২২ মিনিটে দলের পক্ষ থেকে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন নাজমুল হোসেন শান্ত। তিনি মুশফিককে দলের প্রেরণা এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক অনন্য সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করেন। এরপর নিজের অনুভূতি ভাগ করেন মুশফিকুর রহিম। সেখানে ছিল কৃতজ্ঞতা, সংগ্রামের স্মৃতি এবং দেশের জন্য নিজের সেরাটা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি—যা সবসময়ই তার ক্যারিয়ারকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে।
দিনটির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় দলীয় ছবি তোলার মাধ্যমে। গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন মুশফিকের বাবা–মা ও পরিবারের সদস্যরা। তারা তার ক্রিকেট যাত্রার একেবারে শুরু থেকে আজকের এই গৌরবময় মুহূর্ত পর্যন্ত নীরব কিন্তু অটল সঙ্গী হিসেবে ছিলেন। তাদের চোখের উজ্জ্বলতা আর গর্ব যেন মাঠের পরিবেশকেও ছুঁয়ে যায়।
একই সঙ্গে ভক্তরাও মাঠে উপস্থিত ছিলেন। যারা মুশফিকের প্রতিটি অর্জনে যেমন গর্বিত, তেমনই এই বিশেষ দিনে তাদের উচ্ছ্বাস তৈরি করে এক উৎসবমুখর আবহ। দলের সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে তার ভূমিকা ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন অনেকে। টেস্টের মতো কঠিন ফরম্যাটে শততম ম্যাচ খেলার অর্জন প্রতিটি ক্রিকেটারই স্বপ্ন । মুশফিক অধ্যবসায়, প্রতিশ্রুতি এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন।
Leave a comment