জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক সফররত বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাবের সঙ্গে এক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসেন। জাতিসংঘ সদর দফতরের কাছাকাছি অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা এবং বহুপাক্ষিক সহযোগিতা প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
বৈঠকের মূল বিষয়বস্তু-
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, আলোচনায় বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক রূপান্তর, অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা নিয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, প্রেসিডেন্ট স্টাবকে অবহিত করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান লক্ষ্য হলো দেশের জনগণকে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাওয়া এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি শক্তিশালী করা।
অন্যদিকে ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাব বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের এ প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানান এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে আশ্বস্ত করেন।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা-
বৈঠকে বিশেষ গুরুত্ব পায় জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই উন্নয়ন। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের জন্য অভিযোজন ও প্রশমন প্রকল্পে সহায়তা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেন ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট। তিনি উল্লেখ করেন, বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের জনগণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি ভোগ করছে। তাই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া এ সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। তিনি নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সবুজ প্রযুক্তি ও টেকসই অর্থনীতির দিকে যৌথ উদ্যোগের ওপর জোর দেন।
শান্তি ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গ-
আলোচনায় বৈশ্বিক সংঘাত, গাজা পরিস্থিতি ও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও মতবিনিময় হয়। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, শান্তি ও মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সব সময় জাতিসংঘের নীতি অনুসরণ করে এসেছে। ফিনল্যান্ড প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন এবং বহুপাক্ষিক সংলাপ জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
শিক্ষা ও প্রযুক্তি সহযোগিতা-
দুই নেতা শিক্ষাক্ষেত্রে সহযোগিতা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় যৌথ উদ্যোগের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা করেন। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ফিনল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি বাড়ানোর বিষয়েও প্রস্তাব ওঠে। এছাড়া প্রযুক্তি স্থানান্তর, স্টার্টআপ বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনী উদ্যোগে যৌথভাবে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন তারা।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সম্ভাবনা-
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেন, ফিনল্যান্ড বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী দেশ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকা রেখে আসছে। বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারলে দুই দেশের সম্পর্ক আরও গভীর হবে। প্রেসিডেন্ট স্টাবও বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাময় উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে অভিহিত করেন।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বার্তা-
বৈঠকের পর কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের মতো বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশ-ফিনল্যান্ড বৈঠক কেবল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সক্রিয়তার প্রতিফলন। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে যে উদ্যোগ নিচ্ছে, এ বৈঠক তারই অংশ।
নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ইউনূস-স্টাব বৈঠক বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তন, গণতন্ত্র ও শান্তি—এই তিনটি ইস্যু আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন বৈঠকগুলো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক দিকনির্দেশনা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
Leave a comment