ইন্দোনেশিয়ার সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী থমাস ত্রিকাসিহ লেমবংকে চিনি আমদানিতে দুর্নীতির অভিযোগে দেশটির একটি আদালত শুক্রবার সাড়ে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে তিনি অবৈধভাবে আমদানির অনুমতি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ প্রমাণিত হয়, যার ফলে ইন্দোনেশিয়ান রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৬৮ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার। আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, চিনি আমদানির ক্ষেত্রে লেমবং কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই এমন সব কোম্পানিকে সুবিধা দিয়েছিলেন, যাদের ওই সময় চিনি আমদানির ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল না। ফলে স্থানীয় উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয় এবং রাষ্ট্রীয় রাজস্বে বড় ধস নামে।
থমাস লেমবং ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর প্রশাসনের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা। তবে মন্ত্রিত্ব ছাড়ার পর তিনি সরকারের বেশ কিছু নীতির কড়া সমালোচক হয়ে ওঠেন। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি বিরোধী প্রার্থী আনিস বাসওয়েদানের নির্বাচনী প্রচারণার অন্যতম প্রধান পরিকল্পক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু নির্বাচনে বর্তমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও জোকোর সমর্থিত প্রার্থী প্রাবোও সুবিয়ান্তো নিরঙ্কুশ জয় পেলে নির্বাচনের কয়েক দিন পরই লেমবংকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, লেমবং ‘জনস্বার্থকে অবহেলা করে ব্যক্তিগত বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থে’ আমদানি অনুমতি প্রদান করেছিলেন, যা ‘সরকারি নৈতিকতা ও অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর’। তবে লেমবং শুরু থেকেই নিজেকে নির্দোষ দাবি করে এসেছেন এবং মামলাটিকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
আদালতে দেওয়া বিবৃতিতে তিনি বলেন, “আমি কোনো অপরাধ করিনি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী শিবিরে কাজ করার কারণেই আমাকে টার্গেট করা হয়েছে। এটি একটি রাজনৈতিক সাজানো মামলা।”
কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা এমন অভিযোগকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁদের দাবি, “এই মামলার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সব প্রমাণ পর্যালোচনা করেই আদালত রায় দিয়েছেন। এটি একটি সুশৃঙ্খল বিচারিক প্রক্রিয়ার ফসল।”
ইন্দোনেশিয়ায় চিনি আমদানিকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির ঘটনা নতুন নয়। আগেও একাধিক আমদানিকারক ও সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তবে এত উচ্চপর্যায়ের একজন সাবেক মন্ত্রীকে এভাবে কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনা বিরল।
২০১৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার নিজস্ব চিনি উৎপাদন ছিল ২৪ লাখ ৯ হাজার মেট্রিক টন, আর সেই সময় ব্যবহৃত হয়েছিল ২১ লাখ ২ হাজার টন। অর্থাৎ দেশটির চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন থাকা সত্ত্বেও আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল এমন কোম্পানিকে, যারা সন্দেহজনকভাবে চিনি আমদানি করে লাভবান হয়েছিল।
এই রায়কে কেন্দ্র করে দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। লেমবংয়ের রাজনৈতিক সহযোগীরা এই রায়কে ‘ক্ষমতাসীনদের দমন নীতি’র অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে সরকারপন্থী দলগুলো এই রায়কে দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ের একটি মাইলফলক হিসেবে প্রশংসা করেছে।
থমাস লেমবং যদি সুপ্রিম কোর্টে আপিল না করেন বা আপিলেও হারেন, তবে তাঁকে আগামী সাড়ে চার বছর জাকার্তার একটি হাই-সিকিউরিটি কারাগারে বন্দি থাকতে হবে। যদিও তাঁর আইনজীবীরা জানিয়েছেন, তাঁরা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এই রায়ের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি বিরোধী লড়াই এবং রাজনৈতিক প্রতিশোধ—এই দুই বিতর্ক আরও তীব্রভাবে সামনে এসেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রশ্ন উঠেছে, এ ধরনের রায় সত্যিই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য, না কি রাজনৈতিক বিরোধীদের কণ্ঠরোধের জন্য।
সূত্র: রয়টার্স
Leave a comment