একসময়ের একঘরে তালেবান এখন আঞ্চলিক শক্তিগুলোর কূটনৈতিক আগ্রহের কেন্দ্রে। আফগানিস্তানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী তালেবানের সঙ্গে যেসব দেশের সম্পর্ক এক সময় ছিল শত্রুতাপূর্ণ কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত, সেই ভারত, পাকিস্তান ও ইরান এখন ধীরে ধীরে কূটনৈতিক যোগাযোগ ও বাস্তবতাবাদী সংলাপে এগোচ্ছে। তাদের এ আগ্রহকে চিহ্নিত করা হচ্ছে ভূরাজনৈতিক প্রয়োজনে প্রণোদিত নতুন বাস্তবতার স্বীকৃতি হিসেবে।
গত কয়েক সপ্তাহে আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির ব্যস্ত কূটনৈতিক তৎপরতা এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের প্রমাণ। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে সংলাপ, ইরান সফর, বেইজিংয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে অংশগ্রহণ—সবই ইঙ্গিত করে তালেবান এখন বৈশ্বিক মঞ্চে পুরোপুরি একঘরে নয়।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পেলেও, আঞ্চলিক স্বার্থ তালেবানকে উপেক্ষার সুযোগ দিচ্ছে না। কারণ, তারা আজ আফগানিস্তানের শাসক এবং দেশের ভূখণ্ড ও সীমান্তের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কাতারের দোহায় তালেবান দপ্তরের প্রধান সুহাইল শাহীন বলেন, “তালেবান আজকের আফগানিস্তানের বাস্তবতা। আঞ্চলিক দেশগুলো এই বাস্তবতা জানে এবং সেই অনুযায়ী তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।”
ভারতের জন্য এটি এক ধরনের নীতিগত রূপান্তর। তালেবানের প্রথম শাসনামলে (১৯৯৬–২০০১) নয়াদিল্লি কড়াভাবে তাদের বিরোধিতা করেছিল। তখন তালেবানকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার প্রক্সি হিসেবে দেখা হতো, আর ভারত সমর্থন দিয়েছিল তাদের বিরোধী ‘নর্দান অ্যালায়েন্স’কে। কিন্তু ২০২১ সালে তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় আসার পরও, যদিও ভারত এখনও তাদের সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি, তবুও পর্দার আড়াল থেকে শুরু করে প্রকাশ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু করেছে। আফগান ভূমিকম্পে মানবিক সহায়তা পাঠানো, কাবুলে দূতাবাস পুনরায় খোলা এবং মুম্বাইয়ে আফগান কনস্যুলেট চালু—এসব পদক্ষেপ নয়াদিল্লির বাস্তববাদী পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি।
নয়াদিল্লিভিত্তিক ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’-এর উপপরিচালক কবির তানেজার মতে, “কাবুলে যে রাজনৈতিক বাস্তবতাই গড়ে উঠুক না কেন, তা এড়িয়ে যাওয়া ভারতের জন্য কখনোই বিকল্প ছিল না। তালেবান হচ্ছে বাস্তবতা—যদিও এ বাস্তবতা ভারতকে সন্তুষ্ট করে না।”
অন্যদিকে, পাকিস্তান ও তালেবানের সম্পর্ক একসময় ঘনিষ্ঠ হলেও বর্তমানে তা জটিল। ২০২১ সালে তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণের পর পাকিস্তানে সহিংসতা বেড়েছে। ইসলামাবাদ তালেবানকে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)–এর আশ্রয়দাতা হিসেবে সন্দেহ করে। যদিও তালেবান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে, তবুও সীমান্ত উত্তেজনা এবং পাকিস্তানের আফগান শরণার্থী প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত—সব মিলিয়ে সম্পর্ক খারাপের দিকেই গিয়েছে।
পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিশ্লেষক রাবিয়া আখতার বলেন, “ইসহাক দারের কাবুল সফর ও পরে মুত্তাকির সঙ্গে সাক্ষাৎকে কোনো দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কোন্নয়নের বার্তা হিসেবে নয়, বরং তাৎক্ষণিক কৌশলগত প্রয়াস হিসেবে দেখা উচিত।” ভারত-পাকিস্তান সাম্প্রতিক সংঘাতের প্রেক্ষাপটে আফগান ভূখণ্ড ভারতের ব্যবহারের সম্ভাবনা ইসলামাবাদকে দ্রুত কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দিকে ঠেলে দিয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
তালেবানও পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। সুহাইল শাহীন বলেছেন, “আমরা ইসলামাবাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাই, তবে সেটি পারস্পরিক হতে হবে। দোষারোপের খেলা কারও জন্যই সুফল বয়ে আনবে না।”
এদিকে, ইরানও তালেবানকে উপেক্ষা করতে পারছে না। প্রথম শাসনামলে তালেবানের হাতে ইরানি কূটনীতিক হত্যার ঘটনায় তেহরান তাদের সঙ্গে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল। কিন্তু এখন তালেবান শাসনের চার বছর পর ইরানও কূটনৈতিক যোগাযোগ চালু রেখেছে। ‘তেহরান ডায়ালগ ফোরাম’-এ আমির খান মুত্তাকির অংশগ্রহণ এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক সে সম্পর্কেরই প্রতিফলন।
৯/১১ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতির জেরে ইরান অনেক আগেই তালেবানের সঙ্গে নীরব যোগাযোগ শুরু করেছিল। বর্তমানে আঞ্চলিক নিরাপত্তা, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও শরণার্থী সংকট ইরানকেও তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা রাখতে বাধ্য করছে।
চীনও তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সক্রিয়। বেইজিংয়ে আয়োজিত সাম্প্রতিক ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বাণিজ্য এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আলোচনা করেছে। চীন জানিয়েছে, ইসলামাবাদ ও কাবুল কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠায় নীতিগতভাবে একমত হয়েছে এবং শিগগিরই রাষ্ট্রদূত আদান-প্রদান করবে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, তালেবানের সঙ্গে আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর এসব কূটনৈতিক তৎপরতা শুধু বর্তমান শাসকদের বাস্তবতা মেনে নেওয়াই নয়, বরং নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষায় নেওয়া জরুরি পদক্ষেপ। তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি না দিলেও, বাস্তবমুখী কূটনৈতিক যোগাযোগ আজ এক অনিবার্য পরিণতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরাসরি স্বীকৃতি না এলেও তালেবানকে ঘিরে এ বাস্তবতা বিশ্বকে নতুন এক কূটনৈতিক অধ্যায়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে—যেখানে শত্রুতা নয়, স্বার্থ আর স্থিতিশীলতার চাহিদাই প্রাধান্য পাচ্ছে।
Leave a comment