সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পলাশ সাহার মৃত্যু নিয়ে জল্পনা-কল্পনার যেন শেষ নেই। ঘটনাটি প্রথমে আত্মহত্যা হিসেবে বিবেচিত হলেও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া এবং বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণে উঠেছে একাধিক প্রশ্ন, যা ঘটনাটিকে আত্মহত্যা নয়, বরং একটি ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।
পলাশ সাহা তার অফিস চেয়ারে বসা অবস্থায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যান। তার বুকে গুলির চিহ্ন এবং পাশে পড়ে থাকা পিস্তল দেখে প্রাথমিকভাবে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলা হয়। তবে অস্ত্র ব্যবহারে প্রশিক্ষিত কেউ নিজের বুকে গুলি করে আত্মহত্যা করে—এই ধারণা অনেকের কাছেই অসংগতিপূর্ণ মনে হয়েছে। অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যা করে, তারা সাধারণত মাথা, কপাল বা থুতনির নিচের নরম অংশ লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এসব জায়গায় গুলি চালাতে তর্জনী বা বৃদ্ধাঙ্গুলি ব্যবহার করেই কাজটি সহজে সম্পন্ন করা যায়। কিন্তু নিজের বুকে গুলি চালাতে গিয়ে একজন প্রশিক্ষিত কর্মকর্তা কেন একটি জটিল পদ্ধতি বেছে নেবেন, সেটি থেকেই সন্দেহ জন্ম নিচ্ছে।
অন্যদিকে, মৃত্যুর পর পলাশ সাহার বসে থাকার ভঙ্গিটিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। হঠাৎ গুলির প্রচণ্ড আঘাতে একজন ব্যক্তির শরীর যে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা তার শারীরিক অবস্থানে প্রতিফলিত হয়নি। মাথা হেলানো, হাত-পা সোজা থাকার বদলে তাকে যেন সচেতনভাবে চেয়ারে বসানো হয়েছে এমন ভঙ্গিতে পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গুলির আঘাতে স্বাভাবিক শারীরিক অস্থিরতা থাকাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এখানে তা অনুপস্থিত ছিল।
সবচেয়ে বিতর্কিত অংশটি হলো, মৃত্যুর পর পাওয়া পলাশ সাহার হাতে লেখা সুইসাইড নোট। ওই চিরকুটে স্ত্রীর সঙ্গে পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং শাশুড়ির ভূমিকা নিয়েই লেখা ছিল, যা জনমনে আত্মহত্যার পেছনে ব্যক্তিগত সমস্যা দায়ী—এমন বার্তা দেয়। কিন্তু অনেকের মতে, নোটটি পলাশ সাহার হাতের লেখা হলেও সেটি তার নিজের ইচ্ছায় লেখা হয়নি; বরং হুমকি দিয়ে বা ব্ল্যাকমেইল করে লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে। পেশাদার অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, এমন পরিস্থিতিতে একজন মানুষ মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও, সেই অবস্থায়ও সুগঠিত ও পরিকল্পিতভাবে লেখা একটি নোটের উপস্থিতি ঘটনাটিকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে।
সামাজিক মাধ্যমে অনেকে দাবি করেছেন, এটি একটি ‘ওয়েল-প্ল্যানড মার্ডার’। তাদের মতে, পলাশ সাহার বিরুদ্ধে কোনো চক্রান্ত বা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানার কারণে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হতে পারে। কেউ কেউ বলেছেন, পলাশ সাহার ভারত যাতায়াত এবং আন্তর্জাতিক নথিপত্র ফাঁসের সম্ভাব্য সংশ্লিষ্টতা গোয়েন্দা মহলে তার অবস্থানকে বিতর্কিত করে তোলে, যা তাকে একটি লক্ষ্যে পরিণত করেছিল।
যারা পলাশ সাহার পারিবারিক বিষয়াদি জানতেন, তারাই হয়তো এই তথ্যগুলোকে কৌশলে কাজে লাগিয়েছেন। এমনকি, অনেকেই আশঙ্কা করছেন, পলাশ সাহার বিরুদ্ধে পূর্ব-পরিকল্পিত একটি ফাঁদ পেতে পুরো ঘটনাকে আত্মহত্যা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ফলে তদন্তের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান উঠেছে, বিষয়টি যেন পুনরায়, স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা হয়। বিশেষ করে, তার অফিসের সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা, সুইসাইড নোটের ফরেনসিক বিশ্লেষণ এবং ডিজিটাল ফরেনসিক তদন্তের মাধ্যমেই ঘটনার আসল রহস্য উন্মোচন সম্ভব।
এই মৃত্যু যদি সত্যিই একটি ঠান্ডা মাথায় সংঘটিত পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে, তবে তা শুধু একটি ব্যক্তির জীবন নেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি গোটা আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ। এখন প্রশ্ন হলো, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সাহস রাষ্ট্রীয়ভাবে দেখানো হবে কি না।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো নতুন মন্তব্য আসেনি। তবে জনমনে সন্দেহ ও প্রশ্নের যে ঢেউ উঠেছে, তা সহজে স্তিমিত হওয়ার নয়।
Leave a comment