
১৯৪৭ সালের শেষ প্রান্তে উপমহাদেশের ইতিহাসে এক রক্তাক্ত অধ্যায় লেখা হয়, যার রেশ আজও কাশ্মীর উপত্যকার আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়। পাকিস্তান ও আফগান সীমান্তবর্তী অঞ্চলের উপজাতীয় যোদ্ধারা হঠাৎই কাশ্মীরের অভিমুখে এক সশস্ত্র অভিযান চালায়। এই অরাজক, বিশৃঙ্খল ও বর্বর অভিযানের মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর—একটি বিভক্ত ভূখণ্ড, যা আজও দুই দেশের জন্য রাজনৈতিক জটিলতার কেন্দ্রবিন্দু।
বারামুল্লার দিকে ধেয়ে যাওয়া উপজাতীয়দের দল শহরের হাসপাতাল ও ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতে চালায় চরম ধ্বংসযজ্ঞ। সেন্ট জোসেফস কনভেন্ট হাসপাতালের এক সময়কার শিশু বাসিন্দা অ্যাঞ্জেলা রারানিয়া স্মৃতিচারণ করেন—দেয়াল টপকে ঢুকেই মুখভর্তি দাড়িওয়ালা মানুষগুলো বন্দুক তাক করে গুলি চালাতে থাকে। সেই ভয়াবহ মুহূর্তে তিনি দেখেছিলেন, তারা নিহতদের হাত থেকে ঘড়িও খুলে নিচ্ছে। টম ডাইকস নামের আরেক শিশু প্রত্যক্ষ করেছিল নার্সদের আতঙ্কিত মুখ, কাপড় ছেঁড়া দেহ। তাঁর মা-বাবা ওই আক্রমণেই প্রাণ হারান।
উপত্যকার তখনকার শাসক হরি সিং ছিলেন একজন হিন্দু মহারাজা, যার নেতৃত্বে কাশ্মীর একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে ভারতের ও পাকিস্তানের মাঝে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু যখন হামলা শ্রীনগরের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছায়, তখন বাধ্য হয়েই হরি সিং ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তাঁর পুত্র করণ সিংয়ের মতে, এই সিদ্ধান্ত ছিল পাকিস্তান-সমর্থিত হামলার প্রত্যক্ষ ফল, যা তাঁকে ভারতের শরণাপন্ন হতে বাধ্য করে।
তবে ঘটনাপ্রবাহের ব্যাখ্যা একরকম নয়। কাশ্মীরি নেতা সরদার আবদুল কাইয়ুম খান বলেন, এ হামলা ছিল তাঁর নেতৃত্বাধীন এক বিদ্রোহী পরিকল্পনাকে ভণ্ডুল করে দেওয়া এক বিশৃঙ্খল পদক্ষেপ। তাঁর দাবি, পাকিস্তান এই অভিযানে সরাসরি যুক্ত ছিল না; বরং সীমান্ত অঞ্চল থেকে আগত বিশৃঙ্খল যোদ্ধারা লুটপাটে ব্যস্ত হয়ে মূল কৌশলিক উদ্দেশ্য থেকেই সরে যায়।
উপজাতীয়রা যদি লুটপাটে না জড়িয়ে পড়ত, তাহলে শ্রীনগর দখল হয়ে যেত—এমনটাই মনে করেন করণ সিং। কারণ, ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন সেখানে পৌঁছায়, তখন আক্রমণকারীরা বিমানবন্দর থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে ছিল।
এরপর ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীরের একাংশ পুনরুদ্ধার করে এবং দুই পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায়। এর ফলে কাশ্মীর দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়—এক অংশ ভারতের নিয়ন্ত্রণে, অন্য অংশ পাকিস্তানের। এই বিভক্তি আজও টিকে আছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭-এর পর অন্তত তিনবার যুদ্ধ করেছে ভারত ও পাকিস্তান, আর কাশ্মীর উপত্যকা পরিণত হয়েছে দীর্ঘস্থায়ী সহিংস বিদ্রোহ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের কেন্দ্রে।
২০১৯ সালে ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা তুলে দেয় এবং অঞ্চলটিকে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে। কিন্তু সাত দশকের বেশি সময় পেরিয়েও ১৯৪৭ সালের সেই বিভক্তির ক্ষত শুকায়নি।
কাশ্মীর—এখনও এক অমীমাংসিত যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে ইতিহাস প্রতিদিনই নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে।
 
                                                                         
                                                                         
			             
			             
 
			         
 
			         
 
			         
 
			         
				             
				             
				            
Leave a comment