জীবনের প্রতিটি ধাপে ‘বন্ধু’ শব্দটির সংজ্ঞা বদলে যায়। শৈশবে যার সঙ্গে খেলাধুলা করি, স্কুলে একসঙ্গে যাই, টিফিন ভাগ করে খাই—তাকে বন্ধু ভাবি। কৈশোরে যার কাঁধে মাথা রেখে কষ্ট ভাগ করি, তার সঙ্গেই স্বপ্নের কথা বলি। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে গভীর, যেখানে এক প্লেট খাবার, অ্যাটেনডেন্স কিংবা একই পোশাক বানানোতেও থাকে ভালোবাসার ছোঁয়া।
তবে জীবনের এই চলমান পথে একটা প্রশ্ন প্রায়ই এসে পড়ে—আসলে প্রকৃত বন্ধু কে? কাকে বলা যায় এমন বন্ধু, যার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় জীবনের সব কথা, সব অনুভূতি, এমনকি গোপনতম কথাও?
সহপাঠী বা সহকর্মী—সবাই বন্ধু নয়। একসঙ্গে সময় কাটালেই সম্পর্কের নাম বন্ধুত্ব হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও কাপল কাউন্সেলর রউফুন নাহার বলেন, “বন্ধু সেই, যার কাছে আপনি নিরাপদ বোধ করবেন, যিনি আপনার কথা মন দিয়ে শুনবেন, দরকারে পাশে থাকবেন—না চাইতেই।” তার মতে, বন্ধুত্ব একটা সম্পর্কের ধরন, যেখানে আরাম, আস্থা আর সুরক্ষা থাকে।
রউফুন নাহার আরও বলেন, “স্বামী–স্ত্রী, বাবা–মা কিংবা এমনকি বউ-শাশুড়ির মধ্যেও বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে, যদি সেখানে খোলামেলা কথা বলার পরিবেশ থাকে।” তাই, শুধু সম্পর্কের নামেই কেউ বন্ধু হয় না—আসল বন্ধুত্বের নির্ধারক হলো অনুভব, বোঝাপড়া, আর নিরাপদ অনুভব করার সক্ষমতা।
আবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য প্ল্যাটফর্ম বেটারহেল্পের মতে, প্রকৃত বন্ধু সেই, যে বিনা প্রত্যাশায় ভালোবাসে, প্রয়োজনের সময়ে সঙ্গ দেয়, আপনাকে উজ্জীবিত করে, আত্মবিশ্বাস জোগায়, আর কোনো প্রতিদান না চেয়েই পাশে থাকে।
তবে প্রশ্ন হলো—বন্ধু হলেও কি সব কথা বলা যায়? উত্তরটা যতটা সহজ মনে হয়, ততটা নয়। রউফুন নাহার এই বিষয়ে সর্তক করেন। তার মতে, “কাউকে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক গোপন কথা বলার আগে ভাবতে হবে—এটি ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে কি না। কারণ, মানুষ ও সম্পর্ক—দুটোই বদলায়।”
তিনি আরও বলেন, “মন খারাপের সময়ে বন্ধু বা জীবনসঙ্গীকে থেরাপিস্ট ভেবে সব বলা ঠিক নয়। সে ক্ষেত্রে পেশাদার কাউন্সেলর বা মনোবিদের সাহায্য নেওয়াই সঠিক পথ। এতে নিরাপদও থাকা যায়, আবার মনের কথাও বলা যায় পেশাগতভাবে।”
অফিসে, সহকর্মীদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয়, সময় কাটে দারুণভাবে। কিন্তু পেশাগত বন্ধুত্বেও সীমা থাকা জরুরি। নিয়ম-কানুন, প্রতিযোগিতা—এসব পেশার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই এমন বন্ধুত্বে খুব ব্যক্তিগত কথা ভাগ করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
সবশেষে, বন্ধুত্ব যেমন জীবনের আশ্রয়, তেমনি এর জন্য দরকার বুদ্ধিমত্তা ও সংবেদনশীলতা। সম্পর্কের সীমা বুঝে এগোলে তবেই গড়ে উঠবে এমন বন্ধুত্ব—যেখানে থাকবে শ্রদ্ধা, নিরাপত্তা ও ভালোবাসা। তাই বন্ধু চেনার আগে বন্ধুত্বের গভীরতা ও দিকটি বোঝা দরকার, কারণ সব সম্পর্কেই খোলামেলা হওয়া যায় না। আর প্রকৃত বন্ধু সেই, যার পাশে থাকলেই মনে হয়—“এটাই আমার মানুষ।”
Leave a comment