Home জাতীয় ১৯৭১ সালের ২২ মার্চ: এক অনন্য সৈনিক সমাবেশ
জাতীয়

১৯৭১ সালের ২২ মার্চ: এক অনন্য সৈনিক সমাবেশ

Share
Share

১৯৭১ সালের মার্চ মাস ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক উত্তাল সময়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সৈনিকদের মধ্যেও তখন উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ২২ মার্চ তাঁরা ঢাকায় এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেন, যা রাজনৈতিক ও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ছিল এক অনন্য ঘটনা।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। অসহযোগ আন্দোলনের ফলে স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আনুগত্য কমতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা ক্রমশ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাতে শুরু করেন।
এই সময় অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকেরা আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি একাত্মতা ঘোষণা করেন। তাঁদের অনেকেই শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান জানান।
২২ মার্চ প্রাক্তন সৈনিক সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ চত্বরে এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকেরা অংশগ্রহণ করেন। ছুটিতে থাকা অনেক চাকরিরত সৈনিকও পরিচয় গোপন রেখে সমাবেশে যোগ দেন।
সমাবেশ আয়োজনের বিষয়ে ২১ মার্চ প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এ জে এম খলিলুল্লাহ ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ২২ মার্চ বেলা তিনটায় প্রাক্তন সৈনিকদের সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় সভাপতিত্ব করেন মেজর জেনারেল (অব.) ইসফাকুল মজিদ এবং পরিচালনা করেন কর্নেল এম এ জি ওসমানী। সমাবেশে অন্যান্য বক্তাদের মধ্যে ছিলেন মেজর শফিউল্লাহ, লে. কমান্ডার জয়নাল আবেদীন, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট খলিলুল্লাহসহ আরও অনেকে।
এই সমাবেশে বক্তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেন এবং বাঙালি সৈনিকদের অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান। মেজর জেনারেল মজিদ বলেন, “আমরা সৈনিক, কথার চেয়ে কাজে বেশি বিশ্বাস করি।” কর্নেল ওসমানী সৈনিকদের দেশ ও জাতির প্রতি তাঁদের দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট খলিলুল্লাহ আরও স্পষ্ট করে বলেন, “আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি, নির্দেশ পেলে আমরা জানি কীভাবে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়।”
এই সমাবেশে সৈনিকেরা শপথ নেন যে তাঁরা অসহযোগ আন্দোলনকে সর্বাত্মকভাবে সফল করবেন এবং আসন্ন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন। সমাবেশ শেষে তাঁরা কুচকাওয়াজ করে শহীদ মিনারে যান এবং পূর্ণ সামরিক কায়দায় পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
শহীদ মিনারে কর্নেল ওসমানী বক্তব্য দেওয়ার পর সৈনিকেরা রক্তশপথ নেন। এরপর তাঁরা মিছিল করে ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে যান। সেখানে বঙ্গবন্ধু সৈনিকদের স্বাগত জানান। প্রতিনিধিদল অসহযোগ আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। বৈঠককালে মেজর জেনারেল মজিদ বঙ্গবন্ধুর হাতে সংগ্রাম ও আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে একটি তরবারি তুলে দেন, যা বঙ্গবন্ধু চুম্বন করে গ্রহণ করেন।
২২ মার্চের সমাবেশ ঢাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনা তৈরি করে। ইত্তেফাক পত্রিকা লিখেছিল, “প্রাক্তন সৈনিকগণ আজ আর ‘প্রাক্তন’ হিসাবে বসিয়া থাকিতে পারেন না।”
অন্যদিকে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই সমাবেশকে বিপজ্জনক বলে মনে করে। তারা সন্দেহ করে যে প্রাক্তন সৈনিকদের সামরিক প্রস্তুতি নেওয়ার পরিকল্পনা থাকতে পারে। গবেষকরা উল্লেখ করেছেন যে, ২২ মার্চের সৈনিক সমাবেশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উদ্বেগ বাড়িয়ে তোলে এবং এর কয়েক দিনের মধ্যেই তারা ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালায়।
১৯৭১ সালের ২২ মার্চের সৈনিক সমাবেশ ছিল ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটি প্রমাণ করে যে স্বাধীনতার সংগ্রামে শুধু রাজনৈতিক নেতা ও সাধারণ জনগণই নয়, সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরাও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এই সমাবেশ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিকে আরও শক্তিশালী করেছিল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don't Miss

দুদকের অনুসন্ধান শুরু সিআইডির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়ার বিরুদ্ধে

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) , পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাবেক প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ আলী মিয়ার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির...

ঢাকায় সুলতানি আমলের মতো ঈদ মিছিল হবে

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঈদ উদযাপনের নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ঐতিহ্যবাহী ঈদ মিছিল পুনরুজ্জীবিত করার পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে,...

Related Articles

যুক্তরাষ্ট্রে তোলপাড় সিগন্যাল চ্যাট কেলেঙ্কারিতে

সাম্প্রতিক সময়ে, বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ সিগন্যাল-এ সামরিক পরিকল্পনা সংক্রান্ত একটি গ্রুপ চ্যাটে...

পাবনায় ‘অভিভাবকহীন’ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘরটি জিইয়ে রেখেছেন কেসমত আলী

পাবনা জেলার সদর উপজেলার দাপুনিয়া ইউনিয়নের মাধপুরে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘরটি অনাদর-অবহেলায়...

সারজিসের শতাধিক গাড়ির বহর নিয়ে প্রশ্ন তুললেন তাসনিম জারা

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের শতাধিক গাড়ির বহর...

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে স্মৃতিসৌধে প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা নিবেদন

মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে ৭১ এর শহীদ...