মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়ের নাম। বাবরের পুত্র হিসেবে জন্ম নেয়া হুমায়ুন রাজ্যের ক্ষমতা পেয়েছিলেন মাত্র ২২ বছর বয়সে, ১৫৩০ সালের ডিসেম্বরে। বাবরের রেখে যাওয়া সাম্রাজ্যের ভার কাঁধে তুলে নেওয়া তরুণ এই শাসক তখন ছিলেন অভিজ্ঞতাহীন এবং রাজনীতির জটিল চালগুলো বোঝার আগেই তাকে পড়তে হয়েছিল কঠিন এক লড়াইয়ের মুখে। সাম্রাজ্যের উত্তরাংশ তখন ছিল তার সৎ ভাই কামরান মির্জার দখলে, যে পরবর্তীতে হুমায়ুনের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে।
শুরু থেকেই হুমায়ুনের শাসনকাল নানা সংকটে জর্জরিত ছিল। অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র আর সীমান্তের শত্রুদের চাপ সামলাতে গিয়ে তিনি একসময় হারিয়ে ফেলেন বাবরের গড়া মুঘল সাম্রাজ্য। ১৫৪০ সালে শেরশাহ সুরির কাছে পরাজিত হয়ে তাকে প্রাণভয়ে উপমহাদেশ ছেড়ে পালাতে হয়। তবে এখানেই থেমে থাকেনি হুমায়ুনের কাহিনি। ১৫ বছরের দীর্ঘ নির্বাসনকালে তিনি পারস্যে আশ্রয় নেন এবং সেখানকার সাফাভি শাসক শাহ তাহমাস্পের কাছ থেকে সামরিক সহায়তা পান। এই সহায়তার ফলেই তিনি আবার ফিরে আসেন ভারতীয় উপমহাদেশের মাটিতে।
১৫৫৫ সালে তিনি পুনরুদ্ধার করেন তার পূর্বপুরুষদের গড়া গৌরবময় মুঘল সাম্রাজ্য। হুমায়ুনের দ্বিতীয় দফা শাসনকাল যদিও খুবই স্বল্পস্থায়ী ছিল, মাত্র এক বছরের জন্য, তবে তা ছিল দৃঢ় প্রত্যাবর্তনের নিদর্শন। এই স্বল্প সময়েই তিনি সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত গড়ে তুলতে শুরু করেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস—১৫৫৬ সালের জানুয়ারির এক সন্ধ্যায় দিল্লির দিনপানাহ অঞ্চলের নিজস্ব গ্রন্থাগারের সিঁড়ি থেকে পড়ে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন এবং পরদিনই মৃত্যুবরণ করেন।
হুমায়ুনের মৃত্যু যেমন আকস্মিক, তেমনি ইতিহাসে তার জীবন এক ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। বাবরের মতো তিনি যুদ্ধ করেই জীবন কাটিয়েছিলেন, কিন্তু বাবরের মতোই শেষ পর্যন্ত নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। হুমায়ুনের দ্বিতীয় শাসনকালের মাধ্যমেই প্রস্তুত হয়েছিল মুঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগের মঞ্চ, যার নেতৃত্বে পরে আসেন তার পুত্র আকবর।
মুঘল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং উত্তরাধিকার ব্যবস্থার বিচিত্র রীতিনীতিও হুমায়ুনের সময়ে নানা সমস্যা তৈরি করেছিল। বাবর তার সাম্রাজ্য ভাগ করে দিয়েছিলেন দুই পুত্রের মধ্যে, যা ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য ছিল অস্বাভাবিক একটি সিদ্ধান্ত। তৈমুরীয় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় চেঙ্গিস খানের আদলে এই ভাগাভাগির ফলে সাম্রাজ্যের একাধিক উত্তরাধিকারের দাবি তৈরি হয় এবং বাড়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব। বাবরের মৃত্যুর পর হুমায়ুনের অবস্থান ছিল নড়বড়ে, কারণ মাত্র চার বছরের শাসনে বাবর যতটা শক্ত ভিত তৈরি করতে পারেননি, তার জেরে হুমায়ুনের নেতৃত্ব নিয়ে উমরাহদের ভেতরে ছিল দ্বিধা। এমনকি কিছু উমরাহ চেষ্টা করেছিলেন বাবরের জামাই মাহদী খাজাকে সিংহাসনে বসাতে।
সবকিছু পেরিয়ে হুমায়ুন ইতিহাসে বেঁচে আছেন তার হারানো সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের কাহিনির জন্য। পরাজয়ের পর বিজয়ের পথে ফিরে আসা এবং অল্প সময়ের জন্য হলেও পুনরায় সাম্রাজ্যের পতাকা উড়িয়ে দিয়ে যাওয়া এক সাহসী অধ্যায়। আজও নতুন দিল্লির বুকে দাঁড়িয়ে থাকা হুমায়ুনের সমাধি যেন সেই হারিয়ে গিয়ে ফিরে আসার নিঃশব্দ সাক্ষী।
Leave a comment